নন্দলাল মিষ্টি করে হেসে বললেন, “খাটুনির কথা বলছ বাপু?” তা আমাদের ওই ন্যালা পাগলাকে দ্যাখো না, সারাদিন কী খাটুনি না খাটছে। এই সারা গায়ে হরিবোল হরিবোল বলে দৌড়ে বেড়ালোলা, এই তালগাছে উঠে গেল, এই কাকবকের সঙ্গে ঝগড়া করতে লাগল, এই ছেলেপুলেদের তাড়া করল, এই আকাশে ঢিল ছুঁড়তে লাগল, এই ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে এল, তারও কি খাটুনির শেষ আছে?”
‘অ! আপনারও তা হলে ধারণা যে, আমি পাগল? তবে জেনে রাখুন, আর্কিমিডিস, গালিলেওকেও লোকে পাগল বলেই মনে করেছিল একদিন। প্রতিভা আর পাগলামির তফাত বুঝতে এলেম চাই, বুঝলেন মশাই? এই আপনাদের মতো লোকেরা অন্ধ বিশ্বাসে আর কুসংস্কারে দেশটাকে ডুবিয়ে দিচ্ছেন বলেই এদেশে বিজ্ঞানের উন্নতি হল না।”
নন্দলাল চটলেন না। মোলায়েম গলাতেই বললেন, “ওরে বাবা, আমাদের ন্যালা পাগলাও কি যে-সে লোক নাকি? তাকেও তো অনেকে ছদ্মবেশী সাধক, অনেকে শিবের অবতার বলে মনে করে। খামোখা চটে যাও কেন বলো তো? ইতিবৃত্তান্তটা একটু খুলে বলো দেখি শুনি।”
হলধর একটা শ্বাস ফেলে বলল, “যারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে আমি তাদের পছন্দ করি না বটে, কিন্তু আপনাকে আমার একজন বিবেচক মানুষ বলেই মনে হয়েছিল। লোকে বলে আপনি নাকি বেশ বুদ্ধিমান লোক, বিপদে পড়লে লোকে আপনার কাছে বুদ্ধি-পরামর্শ নিতে আসে।”
“তা বাপু, তোমার কি বিপদ যাচ্ছে?”
হলধর অবাক হয়ে বলে, “তবে আর বলছি কী? বিপদ বলে বিপদ! বিপদের ওপর বিপদ। স্পাই তো লেগেইছে, এখন ভাড়াটে খুনিও এসে গেছে। সাধে কি আর মাঝরাতে উঠে বাঁশবনে এসে লুকিয়ে আছি! মশার কামড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত মশাই, তার ওপর পোকামাকড়েরও তো অভাব নেই।”
নন্দলাল চিন্তিতভাবে বললেন, “একটু খুলে বললে হয় না?”
“সেটাই তো বলার চেষ্টা করছি, আপনিই বাগড়া দিলেন।”
“আচ্ছা আর বাগড়া দেব না, বলে ফেলো।”
“ইংরিজি বইটই কি পড়া আছে ঠাকুরমশাই?”
“না হে বাপু, আমার বংশেই ও চর্চা ছিল না। আমার ঠাকুর্দা বলতেন, ও হল ম্লেচ্ছ ভাষা, শুনলে কানে গঙ্গাজল দিতে হয়।”
“ইংরিজি রূপকথায় ডাইনির গল্প আছে। ডাইনিরা নাকি ঝাটায় চড়ে উড়ে বেড়ায়, জানেন কি?”
“আমার নাতির বইতে ওরকম একটা ছবি দেখেছি বটে!”
“কথাটা হল আমি ছেলেবেলা থেকেই ওই উড়ুক্কু ঝটা নিয়ে খুব ভাবতাম। আমার মনে হল সেই আমলের ডাইনিরা ছিল আসলে বৈজ্ঞানিক, কিন্তু সাধারণ মানুষেরা বিজ্ঞানের কাণ্ড দেখে ভয় পেত বলে বৈজ্ঞানিকদের ডাইনি বলে এড়িয়ে চলত। উড়ুক্কু ঝাটার ছবি তো দেখেছেন তো ঠাকুরমশাই, আমাদের বঁটার মতো নয়। লম্বা একটা লাঠির ডগায় ঝাটাটা লাগানো থাকে।”
“তা দেখেছি বটে।”
“আসলে জিনিসটা হল একটা হালকা পোর্টেবল রকেট, লম্বা ডাণ্ডাটা হল রকেটের বডি আর তলার ঝাটাটা হল আসলে ফুয়েল ডিসচার্জ। রকেট যখন আকাশে ওঠে তখন তলার দিকটায় দেখবেন আগুনের যে হলকা বেরোয় তা অনেকটা বঁটার মতোই দেখায়। আইডিয়াটা মাথায় আসতেই আমার মনে হল, এরকম একটা জিনিস তৈরি করতে পারলে চারদিকে হইচই পড়ে যাবে। এখনকার গাবদা গোবদা রকেটের তো অনেক বায়নাক্কা, যখন-তখন যেখানে-সেখানে ব্যবহার করার জো নেই। কিন্তু উড়ুক্কু ঝাটার মতো হালকা রকেট যেখানে-সেখানে যখন-তখন ব্যবহার করা যাবে। ধরুন বর্ষার জলকাদা ভাঙতে হবে না, খালের ওপর সাঁকোটা ভেঙে পড়লেও চিন্তা নেই, হুড়ুম করে ওপর দিয়ে চলে গেলেন। তারপর ধরুন গিন্নি পুঁইডাঁটা কুটে দেখেন মিষ্টি কুমড়োর জোগাড় নেই। তো চট করে দশ মাইল দূরের ময়নাগড়ের হাট থেকে একফালি কুমড়ো কিনে দশ মিনিটের মধ্যে হাসতে হাসতে চলে এলেন। কিংবা ধরুন আপনার শ্বশুরবাড়ির গাছে খাজা কাঁঠাল পেকেছে, শাশুড়ি খবর পাঠাচ্ছেন, কোনও সমস্যা নেই। উড়ুক্কু ঝাটায় চেপে গিয়ে পেটভরে কাঁঠাল সাঁটিয়ে এলেন।”
নন্দলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কাঠালের কথা বলে আর দুঃখ দিও না ভাই। আগে আস্ত একটা কাঁঠাল একাই সাবাড় করতুম। আজকাল আর পেটে সয় না। খেলেই আইঢাই, চোঁয়া ঢেকুর, আমাশা। জিনিসখানা যদি বানাতে পারো তবে যজমানবাড়ি ঘুরে বেড়াতে বড় সুবিধে হয়। এখন চার-পাঁচখানার বেশি লক্ষ্মীপুজো করতে পারি না। ঝটাগাছ হলে দশ বারোখানা হেসে-খেলে পারা যাবে।”
কাঁচুমাচু মুখ করে হলধর বলল, “কাজ তো পনেরো আনা হয়েই গেছে ঠাকুরমশাই, সমস্যা ছিল জ্বালানি নিয়ে। এ রকেট তো হালকা পলকা জিনিস, তেল কয়লা তো আর ভরা যাবে না। তাই বহু খেটেখুটে, মাথা ঘামিয়ে পাঁচ বছরের চেষ্টায় একটা জ্বালানি বানিয়ে ফেলেছি। দিনসাতেক আগেই সেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি উড়ুক্কু ঝটায় প্রথমে গোঁ গোঁ শব্দ হতে লাগল। তারপর হঠাৎ নড়েচড়েও উঠল। একটু উড়ু উড়ু ভাবও যেন হতে লাগল।”
চোখ বড় বড় করে শুনছিলেন নন্দলাল। সাগ্রহে বললেন, “তারপর? উড়ল নাকি?”
“এই হাতখানেক উঠেছিল, বুঝলুম কাজ প্রায় সেরে এনেছি। জ্বালানিতে আর একটা জিনিস মেশালেই ‘জয় মা দুর্গা’ বলে ঝাটা উড়তে লাগবে।”
“তুমি না নাস্তিক?”
“বটেই তো?”
“এই যে বললে জয় মা দুর্গা?”
“বলেছি নাকি?”
“নির্যস বলেছ!”
“ওটা ধরবেন না, কথার কথা।”
“তুমি পাষণ্ড বটে হে! তারপর ঝাটার কথাটা শেষ করো।”