নন্দলাল হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু। তোমার সঙ্গে এঁটে ওঠাই মুশকিল। গল্প উপন্যাস লিখলে তো শরৎবাবুর মতো নাম করতে পারতে হে। এমন প্রতিভা নষ্ট করছ?”
হঠাৎ গোলাপ রায় চোর-চোখে চারদিকটা একটু দেখে নিয়ে গলাটা খাটো করে বলল, “একখানা কথা ছিল ঠাকুরমশাই।”
“বলে ফেলল।”
“সকাল থেকেই বড্ড আপনার কথাই মনে হচ্ছে, ভাবছিলাম, ঠাকুরমশাইয়ের মতো এমন বিজ্ঞ বিচক্ষণ লোক এই অজ পাড়াগাঁয়ে আর কেই বা আছে। কপালের ফেরে পড়ে আছেন বই তো নয়। শহর গঞ্জে গিয়ে পড়লে আপনার সত্যিকারের কদর হত।”
“সে না হয় বুঝলুম, কিন্তু কথাটা কী?”
“একটু গুহ্য কথা মশাই, পাঁচকান করবেন না।”
“সে ভয় নেই। পাঁচকান করা আমার স্বভাব নয়।”
গলাটা আরও খাটো করে গোলাপ রায় বলল, “তা বলছিলাম কী, কর্তাবাবু যে একজন সাঙ্ঘাতিক গুণ্ডাকে ভাড়া করে এনেছেন সে খবর রাখেন কী? সাত ফুটের কাছাকাছি লম্বা আর এই আলিসান তাগড়াই চেহারা। কপাল খারাপ বলে ভাগ্যের দোষে না হয় এসেই পড়েছি মশাই, তা বলে গুণ্ডা দিয়ে পেটাই করা কি ভাল? শত হলেও অতিথি নারায়ণ বলে কথা! ভালয় ভালয় বললে কি তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেয় হতুম না!”
নন্দলাল গম্ভীর হয়ে বললেন, “গুণ্ডাটা তোমাকে কিছু বলেছে বুঝি?”
মাথা নেড়ে গোলাপ রায় বলল, “আজ্ঞে না। বলা কওয়ার লোকও নয়। এ হল কাজের লোক। শুধু দু’খানা চোখ দিয়ে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিচ্ছে, সে কী রক্তজলকরা চাউনি মশাই! পাঁচু বলছিল কর্তাবাবু নাকি মেলা খরচাপাতি করে গুণ্ডাটাকে ভাড়া করে এনেছেন। শুনে তো কাল রাতে মুখে ভাতই রুচল না। সোনামুগের ডাল আর বেগুন ভাজা ছিল মশাই, সবই প্রায় ফেলে উঠে পড়লুম। গুণ্ডাটা আমার মুখোমুখি বসে মাঝে মাঝে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যে, পেটভরে খেতে সাহসই হল না। তাই বলছিলুম ঠাকুরমশাই, গুণ্ডাটা কি আমার জন্যই আনা করালেন কর্তাবাবু?”
নন্দলাল গম্ভীর হয়ে বললেন, “কিছুই বলা যায় না হে, দিনকাল যা পড়েছে।”
‘বড় ভয়ের কথা হল মশাই, মকরধ্বজের গাড়িরও তো এসে পড়ার কথা ছিল। তা সেও এল না। বেঘোরে প্রাণটা গেলে বাড়ির লোক যে খবরটাও পাবে না। শ্রাদ্ধশান্তিরই বা কী ব্যবস্থা হবে কে জানে! উইল টুইলও করে রাখিনি মশাই। তারপর ধরুন, অপঘাতে মৃত্যু। এখানে তো এমন কেউ নেই যে, গরজ করে গিয়ে গয়ায় পিণ্ডটা দিয়ে আসবে।”
একটু ভেবে নন্দলাল বললেন, “অত আগ বাড়িয়ে ভাবা কেন হে? মারলে থানা-পুলিশ হবে, একটু-আধটু কিল, চড়চাপড় বা রদ্দাটদ্দা দিতে পারে বড়জোর। তা ওসব তেমন গায়ে না মাখলেই হল। একটু নজর রেখে চলো, আমি দেখছি।”
“ভরসা দিচ্ছেন ঠাকুরমশাই?”
“দিচ্ছি। ঘাবড়ানোর কিছু নেই।”
“আপনিই বল-ভরসা,” বলে গোলাপ রায় নন্দলালের পায়ের ধুলো নিয়ে ফেলল।
চিন্তিত মুখে নন্দলাল পুকুরধারের রাস্তাটা ধরে এগোচ্ছেন, হঠাৎ পিপুল গাছের আড়াল থেকে রোগামতো দাড়িগোঁফওলা, লম্বা চুলের একজন লোক বেরিয়ে এসে পথ জুড়ে দাঁড়াল।
“ঠাকুরমশাই যে!”
লোকটাকে দেখে নন্দলাল বিশেষ খুশি হলেন না। লোকটা ঘোর নাস্তিক, বৈজ্ঞানিক হলধর হালদার।
নন্দলাল কঠিন গলায় বললেন, “তোমার আবার কী চাই?”
হলধর চাপা গলায় বলল, “ওই গুলবাজটা কী বলছিল বলুন তো আপনাকে! ওর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। ব্যাটা নাকি গ্রহান্তরের মানুষ, ওদের বিজ্ঞান নাকি পঞ্চাশ হাজার বছর এগিয়ে আছে! বলেনি আপনাকে?”
“তা বলেছে বটে।”
“বিশ্বাস করেছেন নাকি ওর কথা?”
“দ্যাখো বাপু, আমি পুজোআচ্চা নিয়ে থাকি, বিজ্ঞান-টিজ্ঞানের আমি কীই বা বুঝি! তবে যা-ই বলো, গুল মারলেও লোকটা তোমার মতো নাস্তিক নয়, ঠাকুর-দেবতাকে মান্যি-গণ্যি করে। ধর্মে মতি আছে।”
“খুব চিনেছেন তা হলে! ধর্মে মতি না হাতি, ও আসলে একটা স্পাই।”
নন্দলাল অবাক হয়ে বলেন, “বলো কী হে? এই অজ পাড়াগাঁয়ে স্পাই ঘোরাঘুরি করবে কেন? এখানে সুলুকসন্ধান করার মতো আছেটাই বা কী?”
হলধর বিরস মুখে বলল, “আছে মশাই, আছে, আর সেইটেই তো দুশ্চিন্তার কারণ। আমার অমন আবিষ্কারটা যদি শত্রুপক্ষের হাতে চলে যায় তা হলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে, পনেরো বছরের সাধনা। এ দেখছি তীরে এসে তরী ডোবার আয়োজন।”
নন্দলাল নাক সিটকে বললেন, “তা কী এমন হাতি-ঘোড়া আবিষ্কার করলে হে? শুনতে তো পাই সারাদিন ঘর বন্ধ করে শিশিবোতল কৌটো বাউটো দিয়ে কীসব খুটুর-মুটুর করো, তা শিশিবোতল থেকে কি বেহ্মদত্তি বেরোল নাকি?”
হলধর ভ্রু কুঁচকে নন্দলালের দিকে চেয়ে বলল, “ও বিদ্যে বোঝার মতো ক্ষমতা আপনার ঘটে নেই, স্পাই কি এই ধ্যাধেরে গোবিন্দপুরে এমনি আসে মশাই? কাঁঠাল পাকলেই ভোমা মাছি এসে জোটে, দেখেননি? এও হচ্ছে সেই ব্যাপার।”
নন্দলাল মাথা নেড়ে ভালমানুষের মতো বললেন, “শুনেছি বটে এক যোজন দূরে গোরু মরলেও নাকি গৃধিনীর ঝুঁটি নড়ে, তা তোমার থলি থেকে কী ম্যাও বেরোল?”
রোষকষায়িত লোচনে নন্দলালের দিকে চেয়ে হলধর বলল, “শুনতে চান? শুনলে মুখের হাসি কিন্তু শুকিয়ে যাবে। এসব তো ঠাট্টা মশকরার জিনিস নয়, অং বং দুটো মন্তর বলে দুটো ফুল ফেলে দিয়ে চাল কলা আর দক্ষিণা আদায়ের ফাঁকিবাজি কারবারও নয়, বিজ্ঞান হল সাধনা আর হাড়ভাঙা খাটুনি।”