নন্দলালকে দেখে নবকৃষ্ণ শশব্যস্তে উঠে বলল, “ঠাকুরমশাই যে! পেনাম হই, পেন্নাম হই।”
“ওহে নবকৃষ্ণ, আমি তো পরিস্থিতি ভাল বুঝছি না। ওই ডাকাতের মতো চেহারার লোকটা কোথা থেকে উদয় হল বল দেখি! ও তো খুনিয়া লোক। এসব লোককে কি বাড়িতে ঠাঁই দিতে আছে? এ তো বিছানায় কেউটে সাপ নিয়ে ঘুমনো!”
নবকৃষ্ণ ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “কর্তা কি কারও বুদ্ধি বা পরামর্শ নেন? বলে বলে তো মুখ পচে গেল মশাই। গতকাল সন্ধেবেলায় ওই ঘটোৎকচটি এসে উদয় হলেন। গুলবাজের মতো চেহারা, ভাঁটার মতো চোখ, কথা কয় না গর্জন করে বুঝে ওঠা মুশকিল। মস্ত নাকি লেঠেল। হাতে দু’খানা তেলচুকচুকে লাঠিও ছিল। তা আমি বললুম, কামশাই, আমদের কি লেঠেলের অভাব? কাহারপাড়ায় একশ’ লেঠেল মজুত, এক ডাকে এসে হাজির হবে। কর্তামশাই খুঁতখুঁত করতে লাগলেন, ওরে, হাতের কাছে একজন লেঠেল থাকাও ভাল। এ লোকটাকে দেখে গুণী মানুষই তো মনে হচ্ছে। একে রাখলে বাড়ির ছেলেপিলেগুলোও একটু লাঠি খেলাটেলা শিখতে পারে, আমাদেরও একটু বলভরসা হয়। আমি আর বেশি কিছু বলতে ভরসা পেলুম না, লোকটা মানুষখেকো চোখে এমনভাবে আমার দিকে চাইছিল যে, গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল বড্ড।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দলাল বললেন, “কর্তাবাবু আর যেগুলোকে জুটিয়েছেন সেগুলো অকালকুণ্ড বটে, কিন্তু ভয়ঙ্কর নয়। কিন্তু এটি তো সুবিধের লোক বলে মনে হচ্ছে না হে। যেমন চেহারা তেমনই ব্যবহার। একটু নজর রাখিস বাবা, যন্তরটিকে কোথায় যেন দেখেছি, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। নামটাম কিছু বলেছে?”
“যে আজ্ঞে। কদম দাস। চক হরিপুরে বাড়ি।”
নামটা চেনা ঠেকল না নন্দলালের। চক হরিপুর কোথায় তাও জানেন না, তবে এসব পাজি লোকের মুখের কথায় বিশ্বাস কী!
“দুর্গা দুর্গতিনাশিনী” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দলাল খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। সামনে দিয়ে যেতে কেমন যেন সাহস হল না।
খিড়কির দিকে পুকুর। পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁতন করছিল গোলাপ রায়।
তাঁকে দেখে বিগলিত হাসি হেসে বলল, “ঠাকুরমশাই যে! তা পুজো সেরে এলেন বুঝি?”
নন্দলাল রোষকরিত লোচনে গুলবাজটার দিকে চেয়ে বললেন, “চ্ছ।”
গোলাপ রায় হাসতে হাসতে বলল, “ওঃ, আমাদের মকরধ্বজ গ্রহে যদি একবার যেতেন ঠাকুরমশাই, তা হলে আপনার পুজোপাঠের খুব সুবিধে হয়ে যেত।”
নন্দলাল গম্ভীর গলায় বললেন, “কীরকম?”
“আরে মকরধ্বজের কাছেই তো ইন্দ্রলোক কিনা। আমরা তো মাঝে-মাঝেই দেখতে পাই সাঁ করে একটা পুষ্পকরথ বেরিয়ে গেল, কিংবা বাঁই করে নারদের টেকি চলে গেল। নিশুত রাতে কান পাতলে তো ইন্দ্রের সভার নাচগানের শব্দও পাওয়া যায়। নূপুরের শব্দ, তবলার বোল, সুরেলা গলার গান, এমনকী কী বলব মশাই, কতদিন ইন্দ্রলোক থেকে ফেলা তরকারি আর ফলের খোসা আমাদের উঠোনে এসে পড়েছে।”
নন্দলাল কটমট করে তাকিয়ে গোলাপ রায়কে ভস্ম করে দেওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, “বটে?”
“তবে আর বলছি কী মশাই! তারপর ধরুন পুজোপার্বণে আপনারা মাটির মূর্তি গড়ে পুজোটুজো করেন। সেদিক দিয়ে আমাদের ভারী সুবিধে। মূর্তিটুর্তির বালাই নেই। যার পুজো হয় তিনিই টুক করে নেমে এসে পুজো নিয়ে চলে যান। গণেশবাবাকে ডাকলেন তোত উনি ধেড়ে ইঁদুরটাকে নিয়ে হেলতে দুলতে এসে হাজির। দিব্যি শুড় দিয়ে চালকলা সাপটে খেয়ে ঢেকুর তুলে উঠে পড়লেন। আমি একবার গণেশবাবার ইঁদুরের লেজ ধরে টেনেছিলাম বলে ইঁদুরটা এমন কামড় দিল, এই দেখুন ডান হাতে এখনও সেই কামড়ের দাগ। তারপর ধরুন মা-সরস্বতী, দিব্যি বীণা বাজাতে বাজাতে হাঁসের পিঠে চড়ে নেমে এলেন। পুজো নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ইংরিজি, বাংলা, অঙ্কও কখনওসখনও দেখিয়ে দেন। তবে আমাদের আসল সমস্যা হয় দুর্গাপূজার সময়। ছেলে, মেয়ে, সিংহ, সাপ, অসুর নিয়ে মা যখন নামেন তখন একেবারে গলদঘর্ম অবস্থা, তার ওপর সিংহটা গাঁক গাঁক করে ডাক ছেড়ে এর ঘাড়ে ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে চায়। অসুরটা ফাঁক বুঝে পালানোর চেষ্টা করে। সাপটা তেড়েফুড়ে কাকে কামড়ায় তার ঠিক নেই। তার ওপর হাঁস প্যাঁচা ইঁদুর ময়ূর সকলে মিলে এক ঝটাপটি অবস্থা। মা দুর্গার দশটা হাত কেন তা আমাদের মকরধ্বজ গ্রহে গেলে বুঝবেন ঠাকুরমশাই। মনে হবে দশটা হাতেও কুলোচ্ছে না। গোলমালে চণ্ডীমণ্ডপ ভেঙে পড়ে আর কী! চারদিন আমাদের নাওয়া খাওয়া ভুলে সামাল দিতে হয়।”
গুরুগম্ভীর মুখ করে নন্দলাল বললেন, “তা হলে তো তোমাদের গ্রহেই যেতে হয় হে।”
একগাল হেসে হাতজোড় করে গোলাপ রায় বলল, “যে আজ্ঞে। বেড়াতে বেড়াতে চলে আসুন একবার। বেশি দূরও নয়, মাত্র আড়াই লক্ষ লাইট ইয়ার। খুব সুবিধে হবে আপনার। মকরধ্বজে আবার অমাবস্যা পুন্নিমে নেই বলে আরও সুবিধে।”
“কেন হে বাপু, সেখানে অমাবস্যা পুন্নিমে নেই কেন?” গোলাপ চোখ গোল করে অবাক হয়ে বলে, “অমাবস্যা পুন্নিমে হওয়ার কি জো আছে মশাই? আমাদের আকাশে একুনে একুশখানা চাঁদ। তা ধরুন কম করেও রোজ রাতে দশ থেকে বারোখানা চাঁদ থাকে মাথার ওপর। অমাবস্যাটা হবে কী করে বলুন? জ্যোৎস্নার ঠেলায় পাগল হওয়ার জোগাড়। দিনে রাতে তফাত করাই মুশকিল। আমার মেজোমামার কথাই ধরুন। ভুলোমনের মানুষ। রাত দেড়টায় দুপুর মনে করে পুকুরে নেয়ে এসে পাতপিড়ি করে বসে হাঁক দিলেন, কই গো, ভাত বেড়ে আনো। মামি তখন ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে এসে বললেন, আ মরণ! মিনসের ভীমরতি হল নাকি? বলে নড়া ধরে তুলে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।”