সবাই উধ্বমুখে কিছু একটা দেখছে। নন্দলাল তাকালেন না। কে জানে কী। তবে যাই হোক, ভগবানের আশীর্বাদে একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠলে ভালই হয়।
আর একজন চেঁচিয়ে বলল, “আমিও দেখতে পাচ্ছি। ওটা বোধ হয় একটা এরোপ্লেন।”
“দুর গাধা। এরোপ্লেন হলে শব্দ হবে না?”
“তাও তো বটে!” একে একে সবাই দেখতে পেল। একটা গুঞ্জন আর চেঁচামেচিও ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
“উরেব্বাস! এ যে লম্বা একটা জিনিস। তাতে কী যেন আছে। চক্কর মারছে।”
গভীর বিকট গলায় ল্যাংড়া শীতল হাঁক মেরে বলল, “সবাই অস্তর হাতে নে। খুব হুঁশিয়ার! একটা ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হচ্ছে।”
নন্দলাল হঠাৎ আর্তনাদ করে বললেন, “সর্বনাশ! ও কাজও কোরো না হে! পুজোর মন্ত্র দেবতাদের পায়ে পৌঁছলে তাঁরা সব পুষ্পক বিমানে যজ্ঞস্থলে এসে হাজির হন। অস্ত্র দেখলে কুপিত হবেন। ওসব লুকিয়ে ফেলো।”
দানবেরা মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল। শীতল বলল, “কোনও বিপদ নয় তো ঠাকুরমশাই?”
“আরে না। আজ পুজো সার্থক হয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র সব দূরে ফেলে দিয়ে হাতজোড় করে বসে আমার সঙ্গে সঙ্গে স্তব করতে থাকো। না হলে সব পণ্ড হবে।”
ডাকাতরা ফাঁপরে পড়ে গেল। ঠিক বিশ্বাসও করছে না, আবার দোটানাতেও পড়েছে।
শীতলই হুকুম দিল, “ঠাকুরমশাই যা বলছেন তাই কর রে তোরা।”
সবাই ঝপাঝপ অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিল। তারপর করজোড়ে স্তব করতেও বসে গেল। নন্দলাল তাদের তাণ্ডব স্ত্রোত্র পাঠ করাতে লাগলেন। যদি সত্যিই কেউ বা কিছু এসে থাকে, তবে তাদের নিরাপদে নেমে আসা দরকার। তাণ্ডব স্তোত্র লম্বা জিনিস। সময় লাগছিল।
ঠিক এই সময়ে সাঁই সাঁই শব্দ করে হলধরের উড়ুক্কু বঁটা তিন মূর্তিমানকে নিয়ে নেমে এল। হাবু দাস লাফ দিয়ে নেমেই চিৎকার করে উঠল, “কই, কোথায় সেই শয়তানটা?”
গোলাপ রায় অবাক হয়ে বলে, “এখানে শয়তানের অভাব কী গো হাবুদাদা? এ তো শয়তানের একেবারে হাট বসে গেছে! তুমি যাকে খুঁজছ সে ওই যে গাছতলায় খাঁড়া হাতে বসে আছে।”
হাবু দাস চোখের পলকে একটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো গিয়ে নকুল সর্দারের ওপর পড়ল। নকুল বিস্ময়ে হাঁ করে ছিল। ওই হাঁ নিয়েই পর পর দুটো রদ্দা খেয়ে জমি ধরে নিল।
তারপর যে কাণ্ড হতে লাগল তা অবিশ্বাস্য। দানোরা কেউ হাত তোলারও সময় পেল না। হাবু-ঘূর্ণিতে তারা খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে লাগল।
তারপর গদাম গদাম করে ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল এখানে সেখানে।
শীতল পালানোর চেষ্টায় ছিল। হাবু তার ঠ্যাং ধরে তুলে কয়েকবার ঘুরিয়ে পাক মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে। শীতল অজ্ঞান হয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো চুপটি করে পড়ে রইল।
লড়াই শেষ।
.
হলধরের উড়ুক্কু বঁটাকে কয়েকবার খেপ মারতে হল। প্রথম খেপে বাড়ি ফিরল রুইতন আর হরতন। একে একে ঠাকুরমশাই নন্দলাল, গোলাপ রায়, হাবু দাস। এবং সেইসঙ্গে অচেতন কদম কোঙার ওরফে নকুল সর্দারও।
নন্দলাল আতঙ্কিত হয়ে বললেন, “ওরে ওটাকে এনেছিস কেন? ও যে সব্বোনেশে লোক!”
হাবু বলল, “বহুকাল পরে লড়াই করে গায়ে হাতে বড্ড ব্যথা হয়েছে মশাই। তাই এটাকে নিয়ে এসেছি। হাত পা টিপে দেবে। ভয় পাবেন না। এর ওষুধ আমার জানা আছে।”
তা কথাটা মিথ্যেও নয়। দেখা গেল, নকুল সর্দার আর আগের মতো নেই। ভারী ভালমানুষ হয়ে গেছে সে। হাবুর গা-হাত-পা টিপে দেয়। তার কাছে কুস্তির প্যাঁচও শেখে, ফাঁইফরমাশ খাটে।
চোখের চাউনিটা একদম গরুর মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
এ বাড়িতে এখন প্রায়ই আন্নাকালী দেব্যা, পীতাম্বরমশাই, আর পঞ্চা বিশ্বাসকে দেখা যায়। কেউ ভয় পায় না বটে, তবে আন্নাকালী দেব্যার শাসনে এখন আর অনাচার হওয়ার জো নেই। দু’বেলা গোবরছড়া গঙ্গাজল দিতে হয় বাড়িতে, তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বলে, শাঁখে ফুঁ।
হলধরের উড়ুক্কু ঝাঁটায় চেপে আজকাল রাঘব বিকেলে বেড়াতে বেরোন, নন্দলাল মাঝে মাঝে যজমান বাড়ি যান, রুইতন আর হরতন বন্ধুদের নিয়ে হইচই করে চড়ুইভাতি করতেও যায়।
লোকমুখে শোনা যায়, ল্যাংড়া শীতলের দল ভেঙে গেছে। শীতল সাধু হয়ে গেছে। দু-চারজন বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে মাধুকরী করে বেড়ায়, কেউ চাষবাসে মন দিয়েছে, কেউ যাত্রার দলে নাম লিখিয়েছে।
তা সে যাই হোক, মোট কথা, হাট গোবিন্দপুরে এখন অখণ্ড শান্তি বিরাজ করছে।