“কে বলো তো বাপু?”
“কেন, রাঘববাবুর দুই ছেলে রুইতন আর হরতন!”
নন্দলাল হঠাৎ বুকে প্রচণ্ড একটা ব্যথা টের পেয়ে চোখ বুজে ফেললেন। হার্ট ফেল হয়ে যাবে কিনা বুঝতে পারলেন না। গেলেই ভাল। এই পঙ্কিল পৃথিবীতে আর বেঁচে থাকার প্রয়োজনই বা কী?
খ্যাক খ্যাক করে একটু হেসে সুধীর বিশ্বাস বলল, “এবার এক ঢিলে দুই পাখি, বুঝলেন ঠাকুরমশাই?”
“না, বুঝলুম না।”
“নরবলিকে নরবলি, তার ওপর মুক্তিপণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা আদায়।”
“শিরে বজ্রাঘাত হবে যে হে!”
“বজ্রাঘাতের কমও হচ্ছে না ঠাকুরমশাই। ল্যাংড়া শীতলের রিষ্টির জন্য আমাদের যে হাঁড়ির হাল। আগে হেসেখেলে মাসে দশ বিশ হাজার টাকা আসত পকেটে। এখন দু-তিন হাজারের বেশি নয়। পাঁচ লাখ এলে খানিক সুসার হয়।”
ছেলে দুটোকে দেখে চোখ ফেটে জল আসছিল নন্দলালের। এদের জন্মাতে দেখেছেন। অসহায় বাচ্চা দুটো দীর্ঘ পথের শ্রমে ঘুমিয়ে পড়েছে।
“বাপু, সুধীর।”
“আজ্ঞে।”
“ওদের বদলে আমাকে বলি দিলে হয় না?”
“তা কি আর হয় না? কিন্তু তা হলে উচ্ছ্বঘ্ন করবে কে? ঠাকুরমশাই, মায়াদয়া কি আর আমাদের মধ্যেও নেই? তবে কিনা, চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা। জন্ম-মৃত্যু কি আমাদের হাতে, বলুন!”
নন্দলাল বিড়বিড় করে বললেন, “তোমার মৃত্যুটা আমার হাতে থাকলে বড় ভাল হত।”
“কিছু বললেন ঠাকুরমশাই?”
“না হে। ইষ্টনাম জপ করছি।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, কষে ইষ্টনাম করুন তো। দুনিয়াটা পাপে যে একেবারে ভরে উঠল ঠাকুরমশাই। ইষ্টনাম হচ্ছে বঁটার মতো, পাপ-তাপের জঞ্জাল সব ঝেটিয়ে সাফ করে দেয়। বেশ চেপে ইষ্টনামটা চালিয়ে যান।”
বকরাক্ষসের মতো নকুল সর্দার গাছতলায় বসে একটা শিরীষ কাগজে খাঁড়ার ধার তুলছে। মুখে একটা লোল হাসি। নরখাদকই বটে। মাঝে-মাঝে চোখ তুলে যখন এধার-ওধার তাকাচ্ছে তখন ওর চোখ থেকে যেন একটা ঝলকানি বেরিয়ে আসছে। কেন যে নকুল সর্দার নাম ভাঁড়িয়ে রাঘব চৌধুরীর বাড়িতে ঢুকেছিল তা এখন খানিকটা বুঝতে পারছেন নন্দলাল। এদের কাজ খুব পাকা। বাড়িতে লোক ঢুকিয়ে পাহারার ব্যবস্থা কেমন, লড়াই দিতে পারবে কি না, রাস্তা আছে কি না তা জেনে নিয়ে তবে কাজে নেমেছে। রাঘবের বাড়ি হল খোলা হাট, সেখান থেকে ছেলে চুরি করা কোনও কঠিন কাজ নয়।
একটা দানো এসে হাতজোড় করে বলল, “ঠাকুরমশাই, আর দেরি হলে যে লগ্ন পেরিয়ে যাবে।”
“এই যে বাপু, যাচ্ছি। হাতপায়ের কাঁপুনিই যে থামতে চাইছে না হে।”
‘ভয় পাবেন না ঠাকুরমশাই। পুজোটা হয়ে যাক, তারপর সারারাত বিশ্রাম করার সময় পাবেন। পুরু গদিওলা বিছানা করে রাখা হয়েছে আপনার জন্য।”
নন্দলাল জপ করতে করতে শান্ত হলেন। হাতমুখ ধুয়ে পুজোর আসনেও বসলেন। চারদিকে ঢাক ঢোল কাঁসি বাজছে। নন্দলাল মন্ত্র-ট ভুলে খুব তাড়াতাড়ি একটা মতলব আঁটছিলেন। কিন্তু জুতমতো কোনও মতলবও আসছে না মাথায়। দুঃখে ক্ষোভে বারবার চোখে জল আসছে।
“বলি ওহে নন্দ!”
নন্দলাল বোজা চোখ খুলে অবাক হয়ে চারদিকে তাকালেন। ঠিক তাঁর গা ঘেঁষে পিছনে একজন বুড়োমানুষ উবু হয়ে বসা। পরনে মোটা আটহাতি ধুতি, গায়ে বেনিয়ান, সাদা ছুঁড়ো গোঁফ, মাথায় কাঁচাপাকা চুল।
নন্দলাল অবাক হয়ে বললেন, “আপনি কে?”
“আমি হলুম পীতাম্বরমশাই। রাঘব চৌধুরীর ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ।”
নন্দলালের গায়ে কাঁটা দিল। “ঘাবড়ে যেও না। পুজোটা একটু সময় নিয়ে করো।”
“যে আজ্ঞে। বড় বিপদ যাচ্ছে পীতাম্বরমশাই।”
“বিপদ বলে বিপদ! তবে ভরসা রাখো৷ পুজোটা চালিয়ে যাও। ওরা তাড়া দিলে বোলো, এ বড় সাঙ্ঘাতিক পুজো। কোনও অঙ্গহানি হলে উলটো ফল ফলবে। আর কিছু ভয় না পাক, পুজোআচ্চাকে খুব ভয় পায়।”
“উপায় হবে বলছেন!”
“না হলে দেড়শো বছরের আলিস্যি ঝেড়ে কি এতদুর ছুটে আসতুম হে? দিব্যি শুয়েবসে সময় কাটছিল, ঝামেলা পাকিয়ে ওঠায় এই দৌড়ঝাঁপের মধ্যে পড়েছি।”
হঠাৎ একটা বাজখাঁই গলা বলে উঠল, “এই যে পুরুতমশাই, পুজো আর কতক্ষণ চলবে? বলিটা দিয়ে না ফেললে কোথায় আবার কী বাধা পড়ে কে জানে!”
পিছনপানে চেয়ে নকুল সর্দারের হাতে লকলকে খাঁড়াটা দেখে চোখ বুজে ফেললেন নন্দলাল। তারপর হঠাৎ বেশ রাগের গলায় বললেন, “দিলে তো মন্তরে একটা বাধা! আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। বলি এ কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি হে! কাঁচাখেগো দেবতা বলে কথা! একটু এদিক-ওদিক হলে রক্ষে আছে? যাও যাও, এখন আমাকে বিরক্ত কোরো না।”
নকুল একটু মিইয়ে গিয়ে বলল, “আহা, বলিটা আগেভাগেই হয়ে যাক না। তারপর সারারাত পুজো চালিয়ে যান, ক্ষতি নেই!”
“তা হলে বাপু, তুমিই বরং পুজোয় বোসস। আমি উঠছি।”
ল্যাংড়া শীতল একটু দূরে বসে ছিল। পেল্লায় একটা ধমক মেরে বলল, “অ্যাই নোকলো! তোর অত সর্দারির দরকার কী? পুজোআচ্চার কিছু বুঝিস?”
নকুল একটু দমে গিয়ে বলল, “এই পুরুতটা একটু খিটকেলে আছে।”
“না, না, এ ভাল পুরুত। সবাই বলে নন্দঠাকুর পুজো করলে ভগবান যেন কথা কয়।”
নকুল তার জায়গায় গিয়ে বসল। নন্দলাল হাঁফ ছাড়লেন।
কে একজন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “আকাশে ওটা কী উড়ছে বলে তো? শকুন নাকি?”
আর একজন বলল, “কখনও শুনেছিস রাতে শকুন ওড়ে। অন্ধকারে দেখলিই বা কী করে?”
“আমি যে অন্ধকারেও দেখতে পাই। না, পাখি-টাখি নয়, তার চেয়ে বড় জিনিস।”