লোকগুলো নিজেদের মধ্যে একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
হাবু হেসেটেসে বলল, “খুবই মজার কথা হে! ধরো যদি আমার নাম হয় হাবু, আর পাঁচুর নাম যদি হয় পাঁচু, আর এই বাড়িটা যদি রাঘববাবুর হয়…”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সামনের লোকটা তার হাতের খেটে ডাণ্ডাটা তুলে ঠাঁই করে হাবুর মাথায় বসিয়ে দিল।
হাবু গদাম করে পড়ে গেল মাটিতে।
কাজের লোক! হু বাবা, এরা যে খুবই কাজের লোক তাতে আর সন্দেহ রইল না গোলাপ রায়ের। বরাবরই সে এইসব কাজের লোককে এড়িয়ে চলে। আজও সে এদের দেখেই ঝোঁপের মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছিল। গা-ঢাকা দিয়েই রইল।
কাজের লোকেরা ফাঁকা পতিত জমিটায় গিয়ে পরপর তিনটে তুবড়িতে আগুন দিল। তুবড়িও বটে! এমন তুবড়ি কখনও দেখেনি গোলাপ রায়। যেমন তেজ, তেমনি বাহার। নানা রঙের ফুলকি যেন ঠেলে দোতলাকেও ছাড়িয়ে গেল। তুবড়ি দেখে দুই ভাই দোতলার জানালায় এসে দাঁড়াতেই কাজের লোকের একজন মোলায়েম গলায় বলল, “তুবড়ি জ্বালাবে খোকারা? এসো না!”
দুই ভাই ছুটে নেমে এল। কাজের লোকেরা চোখের পলকে রুইতন আর হরতনের মুখ দুখানা রুমালে বেঁধে কাঁধে তুলে নিল। তারপর ভারী চটপটে পায়ে গায়েব হয়ে গেল।
খুব সাবধানে সন্তর্পণে বেরিয়ে এল গোলাপ রায়। চেঁচামেচি করল না। করে লাভও নেই। হাবু দাসকে একটু নেড়েচেড়ে দেখল সে। মাথার চোট খুব গুরুতর নয়। সে কয়েকটা গাদাল পাতা ছিঁড়ে হাতে একটু ডলে নিয়ে হাবুর নাকের কাছে ধরতে কিছুক্ষণ বাদে হাবু চোখ চাইল। তারপর ধড়মড় করে উঠে বসেই হুঙ্কার দিল,”কোথায় সেই শয়তানটা?”
“কার কথা কইছ? শয়তান কি একটা? চারদিকে মেলা শয়তান। গণ্ডায় গণ্ডায় শয়তান।”
“ওই যে শয়তানটা কাল রাতে আমাকে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছিল?”
“যাক বাবা, তুমি তা হলে পুরনো হাবু দাসেই ফিরেছ। পুনর্মুষিক ভব। তা কদম কোঙারকে আধঘণ্টা আগে দেখেছিলাম বটে!”
“কোথায় সে?” বলে উঠতে যাচ্ছিল হাবু।
গোলাপ মাথা নেড়ে বলল, “ব্যস্ত হোয়ো না। সে একজন কাজের লোক। কাজেই এ বাড়িতে এসেছিল, কাজ সেরে ফিরে গেছে। তার নাগাল পাওয়া মুশকিল।”
হাবু গম্ভীর হয়ে বলল, “কিন্তু আমার যে তার নাগাল পেতেই হবে!”
.
সামনের উঠোনে সন্ধে সাতটা নাগাদ মেলা লোক জড়ো হয়েছে। হাবু দাস, গোলাপ রায়, গুণেন সাঁতরা, ভূতনাথ, পাঁচু, নবকৃষ্ণ, খাজাঞ্চি মশাই, হলধর, কে নয়? কারও মুখেই কথা নেই।
হলধর, হাবু আর গোলাপ রায় মিলে শক্ত পাটের দড়ি দিয়ে দুটো লম্বা বাঁশ হলধরের উড়ুক্কু ঝাঁটার সঙ্গে আঁট করে বাঁধছিল।
নবকৃষ্ণ সন্দিহান হয়ে বারবার বলছে, “ও হলধরদাদা, এ জিনিস সত্যিই উড়বে তো! দেখলে বিশ্বাস হয় না।”
হলধর বলল, “ওহে নবকৃষ্ণ, এতে শুধু বিজ্ঞানই নেই, তেনারাও আছেন।”
বিশ্বাস রাঘববাবুরও হচ্ছিল না। তবু সামান্য একটু আশার আলো দেখার চেষ্টা করছিলেন মাত্র। শুধু একবার জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকেও যেতে হবে কী?”
হলধর মাথা নেড়ে বলল, “না কর্তামশাই, লোক বাড়িয়ে লাভ নেই। যদি উদ্ধার করা কপালে থাকে তা হলে আমরা তিনজনেই পরব।”
গুণেন বলল, “আমাকেও নিতে পারতে হে! দীপক গেয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আসতাম।”
৭. পালকি চেপে জঙ্গলের ভিতরে
নদী পেরিয়ে আগেরবারের মতোই পালকি চেপে জঙ্গলের ভিতরে দীর্ঘ পথ পার হতে হল নন্দলালকে। জঙ্গলের মধ্যে সেই চাতালেই এসে পালকি নামল।
নন্দলাল নামলেন, চারদিকে যমদুতের মতো চেহারার লোকজন। বেদির ওপর কালীর বিরাট মূর্তি, পুজোর বিরাট আয়োজন চলছে।
নন্দলালের হাত-পা বশে নেই। আগেরবার কৌশলে রক্ষা পেয়েছিলেন। এবার আর তার উপায় দেখছেন না, তবে তার মাথা এখনও পরিষ্কার।
ল্যাংড়া শীতল আগেরবারের মতোই এসে পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, “ঠাকুরমশাই, পুজোটা খুব জোর দিয়ে করবেন। আমার বড় খারাপ সময় যাচ্ছে।”
নন্দলাল স্খলিত কণ্ঠে বললেন, “পুজো না হয় করলুম বাবা, কিন্তু নরবলি-টলি যে আমার সয় না। শেষে যদি রক্তক্ত দেখে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাই তা হলে পুজোই পণ্ড।
শীতল কঁচুমাচু হয়ে বলল, “নরবলি কি আমিই চাই ঠাকুরমশাই? কিন্তু প্রাণায়াম শর্মা সাফ বলে দিয়েছে, নরবলি না হলে আমার রিষ্টি কাটবে না। দেখছেন তো, দিনদিন আমার শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে। আজকাল হাত-পা কাঁপে, জোরে হাঁটলে বুকে হাফ ধরে যায়। আগে এক ঠাই বসে দু’সের মাংস খেতে পারতাম, আজকাল তিন পো-র বেশি পারি না। শরীর খারাপ হওয়ায় দলটাও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, রোজগার কমছে। প্রাণায়াম শর্মা বলেছেন, নরবলিটা হয়ে গেলেই সবদিক রক্ষে পাবে। মায়ের নাকি এখন পাঠা বা মোষে রুচি নেই। একটু নররক্ত খেতে চান। মায়ের ইচ্ছে হলে কী আর করব বলুন!”
“তা বলে মায়ের কোল খালি করা কি উচিত হচ্ছে বাপু? ওটাও যে ঘোরতর পাপ!”
“কিন্তু আমাকেও তো বাঁচতে হবে ঠাকুরমশাই। এতগুলো লোক আমার মুখপানেই চেয়ে আছে।”
নন্দলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
একটু বাদেই পাঁচ-সাতটা লোক এসে ধড়াস ধড়াস করে দুটো মুখবাঁধা বাচ্চা ছেলেকে বেদির কাছাকাছি মাটিতে ফেলল। মশালের আলোয় নন্দলাল দৃশ্যটা দেখে শিহরিত হলেন। ছেলে দুটোকে ভারী চেনা-চেনা ঠেকছিল তার।
সুধীর বিশ্বাস এগিয়ে এসে ভারী আহ্লাদের গলায় বলল, “চিনতে পেরেছেন তো ঠাকুরমশাই?”