“আর ভরসা কোরো না হে। তোমার পরলোকটা বড়ই অন্ধকার।”
দশ-বারোজন লোকে ঘেরাও হয়ে নন্দলাল নৌকোয় এসে উঠলেন। ইষ্টনাম স্মরণ করা ছাড়া তাঁর আর কিছুই করার রইল না।
.
নিজের আশ্চর্য আবিষ্কারের সাফল্যে হলধর নিজেই অভিভূত। বাঁশবনের ভিতরে অন্ধকারে বসে সে কিছুক্ষণ অশ্রুমোচন করল। আনন্দাশ্রুই। বাহবা দেওয়ার মতো কেউ কাছেপিঠে নেই বলে অগত্যা সে নিজেই নিজেকে বাহবা দিয়ে বলল, “না রে হলধর, তোর এলেম আছে বটে! তোর পেটে পেটে যে এত ছিল তা তো কেউ বুঝতেই পারেনি এতকাল! এ তুই যা করলি বাপ, ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কী বুদ্ধি রে তোর! কী ধৈর্য! কী অধ্যবসায়! মানুষের কাছে তুই একটা উদাহরণ হয়ে রইলি। শুধু কি তাই? ইস্কুলে-ইস্কুলে তোর জীবনী পড়ানো হবে একদিন। তোর নামে রাস্তা হবে। কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে তোর ওপর গবেষণা হবে। তোর জন্মদিনের দিন সারা দেশে জন্মজয়ন্তী হবে। না রে হলধর, তুই সামান্য লোক তো নোস…”।
কে যেন বলল, “তা তো নোস বাছা, কিন্তু তোর আক্কেলটা কী? বাঁশবনে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে মেয়েমানুষের মতো কাঁদলেই তো হবে না।”
হলধর তাকিয়ে দেখল, একজন বুড়োমতো বিধবা মহিলা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
হলধর ধরা গলায় বলল, “আজ আমার যে বড় আনন্দের দিন বুড়িমা! বেলুনে বেশি ফুঁ দিলে যেমন বেলুন ফুলে ফাটো-ফাটো হয়, আনন্দে আমার সেই অবস্থা। একটু কাঁদলে আনন্দের বাড়তি বায়ুটা বেরিয়ে যায় কিনা।”
“তা আর জানি না বাছা! তেঁতুলছড়া দিয়ে ভাত খেতুম বলে আমারও কি পেটে কম বায়ু হত? উদ্গার তুললে তবে স্বস্তি পেতাম। তা এই বাঁশবনে বসে অন্ধকারে মশার কামড় খেলেই তো হবে না। এবার যে একটু গতর নাড়তে হবে।”
হলধর আপ্লুত গলায় বলল, “আনন্দের ঠেলায় আমার হাত-পা যে বড় অবশ হয়ে পড়েছে বুড়িমা, হাঁটুতে যেন খিল ধরে আছে। এখন কি আর নড়াচড়ার অবস্থা?”
বুড়ি ফোঁস করে উঠে বলল, “তা বলে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে উড়ুক্কু কল কোলে নিয়ে বসে থাকবি রে নিমকহারাম? বাড়িতে কী কাণ্ড হয়ে গেল সে খবর রাখিস? রাঘব চৌধুরী না তোর অন্নদাতা? তার দুটো ফুটফুটে ছেলে না তোকে এত বিশ্বাস করে? তাদের বিপদে যদি তোর ওই কল কাজেই না লাগল, তা হলে ভেঙেচুরে উনুনে গুঁজে দিগে যা।”
হলধর শশব্যস্তে বলে উঠল, “কেন, কী হয়েছে বুড়িমা?”
“বলব কী, ভাবলেই আমার হাত-পা হিম হয়ে আসছে। এতগুলো পুষ্যি তোরা, গাণ্ডেপিণ্ডে গিলছিস আর কূটকচালি করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছিস! কোন সাহসে অতগুলো ডাকাত ভর সন্ধেবেলা বাড়িতে ঢুকে কচি ছেলেদুটোকে তুলে নিয়ে যায় রে? আস্পদ্দার কথা আরও শুনবি? একটা মর্কট এসে রাঘবকে ভয় দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা চেয়ে গেছে। না দিলে কী হয় ভাবতেও ভয় করে। এখনও কি হাত-পা জড়ো করে বাঁশবনে বসে থাকতে লজ্জা হচ্ছে না তোর? লজ্জা যদি না হয় তা হলে কাল সকালে পাঁচজনকে মুখ দেখাবি কী করে? লোকে যে তোদের গায়ে থুতু দেবে?”
হলধর অবাক হয়ে বলে, “আজ্ঞে, আপনি কে বুড়িমা? ঠিক চিনতে পারছি না তো!”
“চেনার কি জো আছে বাছা? বায়ুভূত হয়ে থাকি। তবে সম্পর্ক খুব দুরেরও নয়। রাঘবের ঠাকুর্দা ছিল বিচরণ, আমি তার বিধবা পিসি। দেখিস, যেন শুনে আবার ভিরমি খাসনে। ভাল ভেবে নবকেষ্টকে বলতে গেলুম, তা সে চোখ উলটে পঁাত ছরকুটে মুচ্ছো গেল। তাই বলি বাছা, এখন কিন্তু মুচ্ছো টুচ্ছো যাসনে। বড্ড বিপদের সময় যাচ্ছে। মুচ্ছো পেলে চেপে রাখ। পরে সময়মতো মুচ্ছো যাস।”
হলধর তাড়াতাড়ি উবু হয়ে পায়ের ধুলো নিতে গেল। বলল, “আপনি কর্তামশাইয়ের ঠাকুর্দার পিসিমা! কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য!”
“পায়ের ধুলো নিলি বুঝি! তা ভাল। ভক্তিছেদ্দার পাট তো আজকাল উঠেই গেছে।”
“কিন্তু ঠাকুমা, হিসেবমতো আপনার বয়স তো দেড়শো দাঁড়াচ্ছে।”
“তা হবে।”
“এতদিন যে কারও বেঁচে থাকার কথা নয়!”
“দুর বোকা! তা হলে এতক্ষণ কী শুনলি? বেঁচে আছি কে বলল?”
“তবে কি ভূত নাকি আপনি ঠাকুমা?”
“ভূত কথাটা শুনতে বিচ্ছিরি, বরং আবছা মানুষ’ বল।” মাথা চুলকে হলধর বলল, “এ! তা হলে তো মুশকিলেই পড়া গেল! সায়েন্সে তো ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না! বড্ড গণ্ডগোলে ফেলে দিলেন ঠাকুমা।”
“বলি, গণ্ডগোলের কি শেষ আছে রে? যেখানে হাত দিবি সেখানেই গণ্ডগোল। তোর সায়েন্সও থাক, আমরাও থাকি। এখন যা বাছা, লোকজন জড়ো করে বেরিয়ে পড়। বাছাগুলোকে যেখানে নিয়ে গেছে সে হল ময়নামতীর জঙ্গল। ভারী দুর্গম জায়গা। তোর ওই উড়ুক্কু কল ছাড়া যাওয়াও যাবে না।”
হলধর চিন্তিতভাবে বলল, “সে না হয় যাচ্ছি। কিন্তু ঠাকুমা, এই উড়ুক্কু কল পলকা জিনিস। পাল্লাও বেশিদূর নয়। তা ছাড়া ছুঁচোবাজির মতো এদিক-সেদিক চলে যায়।
“ওসব নিয়ে ভাবিসনি। আমি আছি, পীতাম্বরমশাই আছেন, হরু বাবা আছে, পঞ্চা বিশ্বেস আছে। আমরা সব আবছা মানুষ বটে, কিন্তু ক্ষ্যামতা কিছু কম নেই।”
গদগদ হয়ে হলধর বলল, “আর একবার পায়ের ধুলো দিন ঠাকুমা।”
.
সন্ধের মুখে বাড়ির পিছনের পতিত জমিতে তিন-তিনটে মুশকো চেহারার লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হাবু দাসের। তাদের দেখে হাবু দাস ভারী খুশি হল। পথ আটকে দাঁড়িয়ে খুব একচোট হেসে নিল সে।