“ওরা কারা?”
“আজ্ঞে, শিবেন, কাদু আর তাঁপা। ওগুলো ওদের আসল নাম নয় অবশ্য। তবে ওই নামেই ডাকে।”
রাঘববাবু হুঙ্কার ছাড়লেন, “ওরে কে আছিস, শিগগির আয়। এটাকে ধরে চোর কুঠুরিতে নিয়ে বেঁধে রাখ।”
সুধীর বিশ্বাস অতিশয় দুঃখের সঙ্গে বলল, “বিপদে পড়লে লোকের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না কর্তামশাই। সেটা দোষেরও নয়। তবে কিনা থাকলে ভাল হত।”
“তার মানে?”
“ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবুন কর্তামশাই। শীতলদাদা তো ধার হিসেবেই চাইছেন। শোধ দিতে একটু দেরি হবে এই যা।”
৬. রোদটা একটু পড়তেই
রোদটা একটু পড়তেই নন্দলাল বেরিয়ে পড়লেন। কর্তাবাবুকে খবরটা একটু দেওয়া দরকার। নকুল সর্দারের মতো লোক তো বিনা কারণে রাঘব চৌধুরীর বাড়িতে ঢোকেনি। পিছনে ল্যাংড়া শীতলের মতো সাঙ্ঘাতিক লোকও আছে।
বাড়ির পুবধারে বাবলা গাছের জড়ামড়ির ভিতর দিয়ে নির্জন সরু রাস্তা। এ-রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই হয়। আরও খানিকটা গেলে বাঁশবন, তারপর খানিক পতিত জমি পার হলে রাঘববাবুর বাড়ির চৌহদ্দি শুরু হয়েছে।
সরু রাস্তায় পা দিতেই সামনে একটা লোক যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল। রোগা চেহারা, সরু গোঁফ, তেলচুকচুকে চুলে নিখুঁত টেরি। মুখে সেইরকমই বশংবদ হাসি আর বিনয়।
“পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই! চিনতে পারছেন?”
খুব চিনতে পেরেছেন নন্দলাল। চিনতে পেরে হাত পা-ঠাণ্ডা মেরে আসছিল তাঁর।
“কী চাও বাপু?”
“আজ্ঞে, আমি সুধীর বিশ্বাস। চিনতে পারলেন না? তেরো মাস আগে একবার এসেছিলুম, মনে আছে?”
কথাটার সরাসরি জবাব না দিয়ে একটা শ্বাস ফেলে নন্দলাল বললেন, “আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি হে। এখন সময় নেই। পরে এসো।”
“আজ্ঞে, আমার দরকারটাও বড্ড জরুরি। দাঁড়াবার দরকার নেই, হাঁটতে থাকুন, আমি পিছু পিছু যেতে-যেতেই কথাটা নিবেদন করতে পারব।”
“তুমি সেই ল্যাংড়া শীতলের লোক তো!”
“যে আজ্ঞে। এবার চিনেছেন।”
“দ্যাখো বাপু, আবার যদি পুজোআচ্চার ব্যাপারে এসে থাকো, তা হলে আগেই বলে রাখছি, ও আমি পারব না। অন্য তোক দেখে নাও গে যাও।”
সুধীর বিশ্বাস ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “সেবার ভারী অসুবিধেয় ফেলা হয়েছিল আপনাকে, জানি। দক্ষিণা প্রণামীটাও বোধ হয় আপনার পছন্দ হয়নি।”
“সেকথা নয় হে বাপু। দক্ষিণা প্রণামী তোমরা ভালই দিয়েছিলে। গ্রামদেশে কেউ অত দেয় না। কিন্তু আর আমি পারব না।”
লোকটা পিছু ছাড়ল না। শেয়ালের মতো পিছু পিছু আসতে-আসতে বলল, “কথাটা যদি একটু শুনতেন!”
“বলে ফেলল।”
“সেবার তো আপনি নরবলি রদ করে মোষবলি দেওয়ালেন। কাজটা খারাপও করেননি। একটা মানুষকে তো প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। সেটা আমার পছন্দই হয়েছিল। নরবলিটলি আমিও বিশেষ পছন্দ করি না।”
“ওহে বাপু সুধীরচন্দ্র, তোমাদের হাতে নরবলি একভাবে না হলেও অন্যভাবে হয়ই। কখনও হাড়িকাঠে ফেলে খাঁড়া দিয়ে কাটো, কখনও হয়তো বোমা-বন্দুক ছুরি-ছোরা দিয়ে মারো। নরবলি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। শাস্ত্রমতো নরবলির বিকল্প ব্যবস্থাই করেছিলাম। কিন্তু ওসব আমার সয় না।”
“কিন্তু ঠাকুরমশাই, মোষবলি দিয়েই কি শীতলদার রিষ্টি কাটল? দিন দিন তাঁর শরীর শুকোচ্ছে, দুর্বল হয়ে পড়ছেন, চলতে ফিরতে হাতেপায়ে কাঁপুনি হয়। মোষবলির কথা শুনে আমাদের প্রাণায়াম শর্মা তো খেপে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন!”
“প্রাণায়াম শর্মাটি আবার কে হে?”
“মস্ত জ্যোতিষী। গ্রহ নক্ষত্র তাঁর দশ আঙুলে খেলা করে। সাক্ষাৎ কাঁচাখেকো দেবতা। গনৎকার হিসেবেও চমৎকার। বললেন, আমার দেওয়া বিধান উলটে দিয়েছে, তার ঘাড়ে ক’টা মাথা? তিনি ফের বিধান দিলেন, এবার দুটো নরবলি।”
“দুটো! নাঃ, লোকটা দেখছি ঘোর পাপিষ্ঠ। যাক, তিনি যে বিধানই দিয়ে থাকুন, তোমরা অন্য ব্যবস্থা দ্যাখো।”
“তাই কি হয় ঠাকুরমশাই?”
“খুব হয়। যে-কোনও পুরুতকে নিয়ে যাও। তা ছাড়া আমার এক জ্ঞাতিভাই মারা যাওয়ায় অশৌচ চলছে।”
“ওসব আমরা মানি না। আর অশৌচ হলে কি কেউ খেউরি হয় ঠাকুরমশাই? আপনার দাড়ি তো চকচকে করে কামানো!”
নন্দলাল বিরক্ত হয়ে বললেন, “সে যাই হোক বাপু, তুমি অন্য ব্যবস্থা দ্যাখো।”
“শীতলদাদা এই হাজার টাকা প্রণামী পাঠিয়েছেন। তা ছাড়া দক্ষিণাটাও এবার একটু মোেটারকমেরই দেবেন। রিষ্টিটা না কাটলেই নয় যে ঠাকুরমশাই! প্রাণায়াম শর্মার বিধান যে বেদবাক্য।”
নন্দলাল বললেন, “ওহে বাপু, আর কথা বাড়িও না। বিদেয় হও। নইলে কিন্তু আমি তোক ডাকব।”
ভারী ভয় পেয়ে এবং আরও সরু হয়ে সুধীর বিশ্বাস বলল, “কুপিত হবেন না ঠাকুরমশাই। শুনেছি আপনি শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ। আপনার শাপটাপ লাগলে আমার কি সইবে? তবে আমি একা নই, এই এঁরাও সব আবদার নিয়ে এসেছেন। সবাইকে পায়ে ঠেলা কি ঠিক হবে ঠাকুরমশাই?”
নন্দলাল দেখলেন, সুধীর বিশ্বাসের পিছনে ঝোঁপঝাড় থেকে অন্তত দশ বারোজন দৈত্যের মতো চেহারার লোক নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে পথ জুড়ে দাঁড়িয়েছে।
নন্দলাল বুদ্ধিমান মানুষ। বুঝলেন, এ সময়ে জেদাজেদি করে লাভ নেই। আপত্তিও টিকবে না।
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাবা সুধীর, তুমি কি পরলোকে বিশ্বাস করো?”
“বলেন কী ঠাকুরমশাই! পরলোকে বিশ্বাস না করে উপায় আছে? ইহলোকটা তো ছ্যাঁচড়ামি করেই কাটল, আমি তো তাই পরলোকের ভরসাতেই আছি।”