রাঘব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তা যাচ্ছে বটে! তা তুমি কে?”
“অধমের নাম সুধীর বিশ্বাস। ধামের কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। যখন যেখানে তখন সেখানে। পেটের ধান্ধায় ভেসে ভেসে বেড়াই আর কী!”
“অ। তা কী চাও বাপু?”
“আজ্ঞে একটা কথা বলতে আসা। ফাঁক বুঝে বলব বলেই এসেছিলাম। তা এসে দেখি কী একটা হাঙ্গামা হচ্ছে। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জুত মতো বলার জন্য আরও একটু দাঁড়িয়ে থাকলে বোধ হয় ভালই হত। কিন্তু ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার মতো বরাত আর ক’জনের হয় বলুন! হাতে আর তেমন সময়ও নেই কি না।”
“তা তো ঠিকই হে। তা কথাটা কী নিয়ে বলো তো?”
লোকটা চারদিকে চেয়ে যেন একটু অবাক হয়েই বলল, “কর্তামশাই, খোকা দুটিকে দেখছি না তো!”
“খোকা! কোন খোকা হে?”
“আপনার খোকা দুটির কথাই বলছি। রুইতন আর হরতন। আহা, বড় ভাল দুটি ছেলে হয়েছে আপনার। যেন দেবশিশু। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।”
“তারা এখন পড়ার ঘরে।”
“ভাল, ভাল। লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়া খুব ভাল। পেটে বিদ্যে, ঘটে বুদ্ধি না থাকলে এই আমাদের মতো অকাজ-কুকাজ করে বেড়াতে হবে। সব ভাল যার শেষ ভাল। যা দিনকাল পড়েছে, খোকা দুটিকে একটু সামলে রাখবেন।”
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার আসল কথাটা কী?”
ভারী অপরাধী মুখ করে মাথা নুইয়ে, হাত কচলে সুধীর বিশ্বাস বলল, “আছে, সেটা পাঁচজনের সামনে বলার মতো নয়। একটু গুহ্য কথা। যদি একটু ফাঁকে আসেন তা হলে সাহস করে বলে ফেলি।”
“অ, তা এসো, ফাঁকেই এসো।”
বৈঠকখানায় ঢুকে চারদিকে চেয়ে সুধীর বিশ্বাস বলল, “বাঃ, বেশ বৈঠকখানাটি আপনার। এসব ঘরে বাস করলে মনটাও উঁচু থাকে। মেজাজও ভাল হয়।”
“সে তো বুঝলুম, কিন্তু কথাটা কী?”
“এই যে বলি। কোন মুখে বলব সেইটেই ভাবছি। বড় কথা ছোট মুখে কেমন মানাবে, সেটাও চিন্তার বিষয়।”
“অত সঙ্কোচ কীসের হে? বলে ফেললেই ল্যাটা চুকে যায়।”
ঘাড়টাড় চুলকে, লজ্জার হাসি হেসে, হাত-টাত কচলে সুধীর বিশ্বাস বলল, “কর্তামশাই, লাখপাঁচেক টাকা হবে?”
রাঘব হাঁ হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থেকে বললেন, “কী বললে হে? ঠিক শুনেছি তো!”
সুধীর বিশ্বাস মাথা নিচু করে বলল, “আজ্ঞে, একবার বলতেই মাথা কাটা গেছে। দু’বার পেরে উঠব না। ভারী লজ্জা করবে না আমার। তবে বলি, ঠিকই শুনেছেন।”
“পাঁচ লাখ টাকা! তার মানে কী?”
সুধীর বিশ্বাস ভারী সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে পাঁচ লাখ টাকার মানে পাঁচ লাখ টাকা বলেই তো মনে হচ্ছে। না হয় ডিকশনারিটা একটু দেখে নিন।”
“বলি পাঁচ লাখ টাকা আছে কিনা জেনে তোমার কাজ কী?”
সুধীর বিশ্বাস লজ্জার হাসি হেসে বলল, “আজ্ঞে, আমার আর কাজ কী? পাঁচ লাখ টাকা কেন, আমি পঞ্চাশ টাকারই হিসেব গোলমাল করে ফেলি। আর পাঁচ লাখ পেলেই বা রাখব কোথায়? চালচুলো নেই, চোরে ডাকাতে কেড়ে নেবে।”
“তা হলে পাঁচ লাখ টাকার কথা উঠছে কেন?” হাতজোড় করে সুধীর বিশ্বাস বলে, “সে আমার জন্য নয় কর্তামশাই।”
“তা হলে?”
“শ্রদ্ধাস্পদ ল্যাংড়া শীতলের জন্য। তিনি বলে পাঠিয়েছেন, গরিব দুঃখীদের তো আপনি কতই বিলিয়ে দেন। তাঁকেও না হয় দিলেন। দান-ধ্যান না করলেও চলবে। দীর্ঘমেয়াদী হাওলাত হিসেবে দিলেও ক্ষতি নেই। ধরুন বছর পঞ্চাশেক পর থেকে তিনি দু’-পাঁচ টাকা করে শোধ দিতে শুরু করবেন।”
“বলি তুমি পাগলটাগলনও তো!না কি ইয়ার্কি মারতে এসেছ?” জিভ কেটে, নিজের দু’খানা কান স্পর্শ করে সুধীর বিশ্বাস বলল, “আজ্ঞে, ইয়ার্কি মারব কী কর্তামশাই, আপনার সঙ্গে কথা কইতে যে আমার হাঁটুতে হাঁটুতে কত্তাল বাজছে! মান্যিগন্যি লোকেদের সঙ্গে কথা বলার কোন যোগ্যতাটা আছে আমার?”
“এই ল্যাংড়া শীতলটা কে?”
“আজ্ঞে, শ্রদ্ধেয় শীতলদাদাও একজন মান্যগণ্য লোক। তবে তাঁর এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। একটা কঠিন ফাঁড়া আছে সামনে। তাই বড় নেতিয়ে পড়েছেন। ব্যবসাবাণিজ্য লাটে উঠেছে।”
“পাঁচ লাখ টাকা চেয়ে পাঠায়, তার বেজায় বুকের পাটা দেখছি!”
“যে আজ্ঞে যথার্থই বলেছেন। আমাদের শীতলদাদা অবস্থার বিপাকে পড়লেও ওই একটা জিনিস এখনও আছে। তা হল বুকের পাটা।”
“এখন এসো গিয়ে। আমার অনেক কাজ আছে।”
“যে আজ্ঞে। তা হলে শীতলদাদাকে গিয়ে কী বলব?”
“বোলো, টাকা অত শস্তা নয়।”
“আজ্ঞে, তাই বলব। তা হলে আমি আসি গিয়ে।”
“এসো।”
“তা কামশাই, যাওয়ার আগে আপনার খোকা দুটিকে একবারটি একটু আদর-টাদর করে যেতে পারি কি?”
“না হে, তারা লেখাপড়া করছে।”
ঠিক এই সময়ে পাঁচু ধেয়ে এসে বলল, “কর্তাবাবু, ছেলে দুটোকে যে গুণ্ডারা তুলে নিয়ে গেল!”
রাঘব সটান হয়ে বললেন, “অ্যাঁ!”
“হ্যাঁ কর্তাবাবু! পিছনের মাঠে তুবড়ি ফুটছে দেখে দুই ভাই নীচে নেমে দেখতে গিয়েছিল। রতন নিজের চোখে দেখেছে, তিন-চারটে মুশকো জোয়ান রুইতন আর হরতনকে ধরে কাঁধে ফেলে হাওয়া হয়ে গেছে।”
“সর্বনাশ! শিগগির লেঠেলদের খবর পাঠা। কোথায় নিয়ে গেল দেখ, কী সব্বোনেশে কাণ্ড!”
সুধীর বিশ্বাস যাই-যাই করেও যায়নি। ভারী জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ানো, তার দিকে চোখ পড়তেই রাঘব হুঙ্কার ছাড়লেন, “এ কি তোমার কাজ?”
মাথা নেড়ে সুধীর বিশ্বাস বলল, “আজ্ঞে না। কাজ সব ভাগ করা আছে কিনা।”
“তার মানে?”
“যার যে কাজ। আমার কাজ ছিল আপনার কাছে কয়েকটা কথা নিবেদন করার। তার বেশি নয়।”