“তারপর ধরুন শুভকার্যে বেরোচ্ছেন, দুর্গা দুর্গা বলে বেরোতে পা বাড়িয়েছেন, একটা বদমাশ ভূত টক করে খুতির খুঁটটা দিল পায়ে জড়িয়ে। দড়াম করে পড়লেন আর কী। ভূতের কাজ বলে টেরটিও পেলেন না।”
রাঘব সোৎসাহে বললেন, “ঠিক বলেছেন তো! গত বছর আমার তো একবার এরকম হয়েছিল।”
“শুধু কি তাই বাবুমশাই! ধরুন, আপনার শুদ্ধাচারী বিধবা শাশুড়ি একাদশীর পরদিন চারটি ভাত পাথরের থালায় বেড়ে নিয়ে খেতে বসেছেন, একটা শয়তান ভূত টুক করে একখানা মাছের কাঁটা তার পাতে ফেলে গেল। কী সর্বনাশ বলুন তো!”
রাঘব মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, এরকম তো হতেই পারে। হয়ও।”
“আর চিন্তা নেই মশাই। আজ থেকে এই শৰ্মা গ্যাঁট হয়ে বসল এই বাড়িতে। ত্রিসীমানায় আর ভূতের উপদ্রব থাকবে না।”
রাঘববাবু তাঁর পুরনো কাজের লোক নবকৃষ্ণের দিকে চেয়ে বললেন, “কী রে নবু, এরকম একজন তোক বাড়িতে থাকা তো ভালই, কী বলিস?”
নবকৃষ্ণ রাঘববাবুর তামাক সেজে কলকেতে ফুঁ দিতে দিতে গড়গড়ার মাথায় বসাচ্ছিল। খুব নির্বিকার গলায় বলল, “ওঝা-বদ্যি রাখুন তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু তা হলে পীতাম্বরমশাই, হরুখুড়ো, পঞ্চা বিশ্বেস, আন্নাকালী দেব্যা এদের কী ব্যবস্থা হবে? তেজালো ওঝা দেখলে তাঁরা কি ভড়কে যাবেন না?”
রাঘব খুবই চিন্তিত হয়ে তামাক টানতে টানতে বললেন, “হ্যাঁ, সেটাও তো একটা কথা! ওঝা ঢুকলে তাঁরা যদি যাতায়াত বন্ধ করে দেন তা হলে তো সর্বনাশ!”
ভূতনাথ হাঁ করে দু’জনের কথা শুনছিল। বড় বড় চোখ করে বলল, “আপনারা কাদের কথা কইছেন? এরা সব কারা?”
রাঘব তামাক টানতে টানতে নিমীলিত চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে বললেন, “এঁরা এ বাড়ির পুরনো আমলের মানুষ সব। পীতাম্বরমশাই আর হরুখুড়ো আমারই ঊর্ধ্বতন পঞ্চম আর সপ্তম পুরুষ। পঞ্চা বিশ্বেস এ বাড়িতে দেড়শো বছর আগে কাজ করত, এইনবকৃষ্ণেরই ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ, আন্নাকালী দেব্যা ছিলেন আমার ঠাকুর্দার বিধবা পিসি। আনাচে কানাচে থাকেন, সারা বাড়িতে ঘুরঘুর করেন।”
নবকৃষ্ণ বলল, “এঁরা তো আছেই, তা ছাড়া পালে পার্বণে আরও অনেকে এসে জুটে যান। তাই বলছিলাম, ওঝাবদ্যি বসান দিলে এঁরা কুপিত হয়ে যদি তফাত হন তা হলে কি বাড়ির মঙ্গল হবে?”
ভূতনাথ ভারী ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বলল, “ওরে বাবা! তাঁরা কি দেখাটেখাও দেন নাকি গো নবুদাদা?”
“তা দেবেন না কেন? নিত্যিই দেখছি। একটু আগেই তো গোয়ালে সাঁজাল দিতে গিয়ে পীতাম্বরমশাইকে দেখলুম, কেলে গোরুটার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন?”
ভূতনাথ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “বাপ রে! এ বাড়িতে তো তা হলে ভূতের মচ্ছব।”
নবকৃষ্ণ বলল, “উঁহু, উই, ভূত বললে এঁদের ভারী অপমান হয়। হেঁদো ভূত তো নন। দেয়াল করতেও আসেন না। বাড়ির মঙ্গলামঙ্গলের কথা চিন্তা করেই চারদিকে নজর রাখেন আর কী!”
শুনে ভূতনাথ ভিরমি খায় আর কী! মাথায় জলটল দিয়ে তাকে সুস্থ করার পর রাঘববাবু বললেন, “তোমার ভয় নেই হে, আমার বাড়িতে যাঁরা আছেন তাঁরা সবাই নিপাট ভাল লোক। শুধু ওই আন্নাঠাকুমাই যা একটু খাণ্ডার। তাকে না ঘাঁটালেই হল। যা রে নবু, ওকে ব্যারাকবাড়ির পুবদিকের ঘরখানায় বন্দোবস্ত করে দে।”
তা ভূতনাথও রয়ে গেল। এভাবেই এক-একজন এসে ঢুকে পড়ে এ বাড়িতে। তারপর আর নড়তে চায় না। বৈজ্ঞানিক হলধর হালদার একসময়ে কালিকাপুর ইস্কুলে বিজ্ঞানের মাস্টার ছিলেন। মাথাপাগলা মানুষ। ইস্কুল কামাই করে বাড়িতে বসে নানারকম উদ্ভট বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতেন। শেষে ইস্কুলের কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে তাঁকে চাকরি থেকে ছাড়িয়েই দিল। বিপাকে পড়ে তিনিও এসে একদিন জুটে গেলেন রাঘবের বাড়িতে। এদের জন্যই বাড়ির লাগোয়া একটা ব্যারাকবাড়ি করে রেখেছেন রাঘববাবু, কম করেও পঁচিশ-ত্রিশখানা ঘরে নানারকম লোক থাকে। বেশিরভাগই নিষ্কর্মা, কারও কারও নানা বাই-বাতিক, কেউ কেউ ভণ্ডুলকর্মা, অর্থাৎ বৃথা কাজে সময় কাটান।
রাঘববাবুর এই যে অজ্ঞাতকুলশীল উটকো লোকদের আশ্রয় দেওয়া, এটা বাড়ির লোকেরা মোটেই ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু তাঁকে বলে বিশেষ লাভ হয় না। বড়ই দয়ার শরীর। লোকে যা বলে তাই বিশ্বাস করে বসেন। কিছুদিন আগে পিছনের বাগানের আগাছার জঙ্গলে একজন লোককে পড়ে থাকতে দেখে বাগানের মালি চেঁচামেচি শুরু করে। লোকটাকে তুলে এনে মুখেচোখে জল থাবড়ানোর পর সে জ্ঞান ফিরে পেয়ে যা বলল তা আষাঢ়ে গল্প। সে নাকি এই পৃথিবীর লোক নয়। অনেক দূরে অন্য এক নীহারিকায় এক গ্রহে তার বাস। মহাকাশযানে তারা ভুল পথে এদিকে এসে পড়ে। তার সঙ্গীরা নাকি ষড়যন্ত্র করে তাকে এখানে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে। গ্রহান্তরের লোকের বাংলা ভাষা জানার কথা নয়, পরনে ধুতি আর জামা থাকারও কথা নয়। ভেতো বাঙালির মতো চেহারাই বা তার হবে কেন? কেউ তার কথা বিশ্বাস করল না বটে কিন্তু রাঘববাবু খুঁতখুঁত করতে লাগলেন, আহা, হতেও তো পারে। দুনিয়ায় কত কী-ই না ঘটে, কেষ্টর জীব, ফেলতে তো পারি না।
তা সেই গুলবাজ গোলাপ রায়ও দিব্যি বহাল তবিয়তে ব্যারাকবাড়িতে গদিয়ান হয়ে বসেছে।
কিন্তু এই নতুন অভদ্র লোকটা নন্দলালকে খুব ভাবিয়ে তুলল। তিনি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে ভিতরবাড়িতে গিয়ে নবকৃষ্ণের ঘরে হাজির হলেন। নবকৃষ্ণ এ-বাড়ির ম্যানেজার। এ-বাড়ির সবকিছু দেখভাল করার ভার তার ওপর। দশ-বারোজন চাকর আর গুটি আট-দশ ঝি তারই অধীনে দিনরাত খাটে। বছর চল্লিশেক বয়সের নবকৃষ্ণকে বিবেচক মানুষ বলেই মনে হয় নন্দলালের।