নবকৃষ্ণ কলকেটা প্রায় ধরিয়ে ফেলেছে। অন্যমনস্ক না হয়ে বলল, “ওসব ছোটখাটো দোষ ধরবেন না। আগুনে দোষ নেই। অগ্নিশুদ্ধ হলে সব শুদ্ধ।”
“বলি কথা তো মেলাই শিখেছিস দেখছি। এত শাস্ত্রজ্ঞান কবে থেকে হল?”
কলকেটা ধরিয়ে ফেলে এবার নবকৃষ্ণ মুখ তুলে চেয়ে দেখল, ছাদের সিঁড়িতে এক বিধবা ঠাকরুন দাঁড়িয়ে। পরনে থান, মাথায় কদমছাঁট চুল, চোখ দুখানায় খুব তেজ। তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, “পেন্নাম হই মা ঠাকরুন, তা কোথা থেকে আসা হচ্ছে?”
“কোথা থেকে আবার আসব রে মুখপোড়া? আমার কি কোথাও যাওয়ার জো আছে? মায়ার বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি, আজও উদ্ধার পেলুম না।”
নবকৃষ্ণ গদগদ হয়ে বলল, “যা বলেছেন মা ঠাকরোন। মায়া হল কাঁঠালের আঠা, সহজে ছাড়তে চায় না। বড় চটচটে জিনিস। তা মা ঠাকরোন, কর্তাবাবুকে খবর দেব, না গিন্নিমাকে? আপনি কোন তরফের লোক তা তো ঠিক জানা নেই কিনা।”
“কেন রে হাঁদারাম, জানা নেই কেন? পাঁচ কুড়ি বছর ধরে ঘাঁটি গেড়ে বসে নিত্যি তোদের অনাছিষ্টি দেখছি, আমি কি উটকো লোক রে অলপ্পেয়ে? শুদ্ধাচার লোপাট হয়েছে, গোবর গঙ্গাজলের তো বালাই-ই নেই, তুলসীমঞ্চে কেউ একবার সাঁঝের পিদিমটা অবধি জ্বালে না। যত দেখছি তত গায়ে জ্বালা হচ্ছে। এর চেয়ে বরং ট্যাঁশদের খাতায় গিয়ে নাম লেখা, বালাই চুকে যাবে।”
লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকে নবকৃষ্ণ বলে, “সেসব ছিল বটে সব ঠাকরোন, তবে কে করে বলুন! দোষঘাট নেবেন না, আপনি তো এসেই গেছেন, এখন থেকে সব আগের মতোই হবে’খন। তা রাত্তিরে কী খাবেন বলুন দেখি! দুধ আছে, মর্তমান কলা আছে, খান্দেসরি চিনি আছে, চারটি সাগুটা ভিজিয়ে রাখব কি?”
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিলা বললেন, “আর খাওয়া! সে তো কতকাল আগেই ঘুচে গেছে। আর খেলেও কি তোদের মতো অনাচারী ম্লেচ্ছদের হাতে খাব নাকি রে নচ্ছার? হেগোবাসী ছাড়ার বালাই অবধি ঘুচিয়ে দিয়ে বসে আছিস। নরকে যাবি যে!”
নবকৃষ্ণ ভারী কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “সে তো বটেই মা ঠাকরোন। পাপের বোঝা নিত্যি ভারী হচ্ছে।”
মহিলা একটু নরম গলায় বললেন, “তা হ্যাঁ রে, আমাকে কি সত্যিই চিনতে পারলি না?”
মাথা চুলকে নবকৃষ্ণ লাজুক মুখে বলল, “চেনা চেনা ঠেকছে মা ঠাকরোন, তবে বুড়ো হচ্ছি তো, স্মৃতিভ্রংশ মতো হয়।”
“তবে যে ভূতনাথের কাছে আমার নামে গল্প ফাঁদলি! খুব যে বললি, আন্নাকালী দেবী এ বাড়ির আনাচেকানাচে ঘোরে।”
একগাল হেসে নবকৃষ্ণ বলে, “সে আর কবেন না মা ঠাকরোন, ভূতনাথটা বড্ড মিথ্যেবাদী। ভূতের গপ্পো ফেঁদে বসেছিল কর্তাবাবুর কাছে। উনি তো আবার ভালমানুষ লোক, যে বলে বিশ্বাস করে ফেলেন। তাই ভূতনাথকে ভড়কে দেওয়ার জন্য বানিয়ে ছানিয়ে বলেছিলাম আর কী। পীতাম্বরমশাই, হরুখুড়ো, পঞ্চা বিশ্বাস, আন্নাকালী দেব্যা…”
মহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বানিয়ে বলেছিলি বটে, কিন্তু মিথ্যে বলিসনি রে।”
“তা মা ঠাকরোন, আপনি এসব জানলেন কী করে? ভুতোটা বলেছে বুঝি?”
“না, ভূতনাথ বলবে কেন? আমি তো সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কানেই শুনেছি।”
ভারী অবাক হয়ে নবকৃষ্ণ বলল, “কিন্তু মা ঠাকরোন, সেখানে যে তৃতীয় ব্যক্তি কেউ ছিল না!”
“কে বলল ছিল না? না থাকলে শুনলুম কী করে রে হতভাগা? এখনও কি তোকে বলে দিতে হবে যে, আমিই আন্নাকালী দেব্যা?”
“অ্যাঁ।”
“হাঁ করে রইলি যে বড়! বলি আকাশ থেকে পড়লি নাকি?” নবকৃষ্ণের হাত থেকে কলকে পড়ে গেল। সে মেঝেয় পড়ে চোখ উলটে গোঁ গোঁ করতে লাগল।
আন্নাকালী ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “আ গেল যা! এ যে দাঁতকপাটি লেগে ভিরমি খেল। একটা কাজের কথা বলতে এলাম, দিল সব ভণ্ডুল করে। এখন যে কী করি!”
পিছনের ফটকে ডাকাত পড়ার খবরটা দিতে এসে রুইতন আর হরতনই নবকৃষ্ণকে ওই অবস্থায় দেখতে পেল।
কাছে গিয়ে হরতন নবকৃষ্ণের অবস্থা দেখে বলল, “দাদা, নবুদা শুয়ে শুয়ে গান গাইছে কেন রে?”
“ধ্যাৎ, নবুদা কখনও গানটান গায় না।”
“তা হলে কি নাক ডাকছে?” রুইতন একটু বড়। তার বুদ্ধি বিবেচনা হয়েছে। সে দেখেটেখে বলল, “না, নবুদা বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। বাবাকে খবর দিতে হবে।”
খবর পেয়ে রাঘববাবু এলেন, অন্য লোকজনও এসে গেল। চোখে মুখে জল ছিটোবার পর নবকৃষ্ণ চোখ মেলেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে বলল, “আমি দেশে যাব কর্তাবাবু, আমাকে ছুটি দিন।”
“কেন রে, কী হল হঠাৎ?”
এ ভূতের বাড়িতে আর থাকব না। রাঘববাবু অবাক হয়ে বললেন, “ভূতের বাড়ি! বলিস কী? এ বাড়িতে এক জন্ম কাটিয়ে দিলি, কখনও ভূতটুত দেখেছিস?”
“কিন্তু আজ যে স্বয়ং আন্নাকালী দেব্যা দেখা দিয়েছেন।”
“দূর বোকা! কী দেখতে কী দেখেছিস!”
উঠে বসে মাথা নেড়ে নবকৃষ্ণ বলল, “শুধু দেখা নয় কর্তাবাবু অনেকক্ষণ কথাবার্তাও হয়েছে। ভুল দেখা টেখা নয়।”
রাঘববাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “তাই তো রে! তা আন্নাপিসি চায় কী? গয়ায় পিণ্ডি দিতে হবে নাকি?”
জড়ো-হওয়া লোকজনের ভিতর থেকে পরিপাটি ধুতি আর পাঞ্জাবি পরা সরুমতো একটা লোক এগিয়ে এল। লোকটার সবই সরু। শরীর সরু, মুখ সরু, নাক সরু, গোঁফ সরু এবং এমনকী চোখের ধূর্ত চাউনিটা অবধি সরু।
জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে লোকটা বিনয়ী গলায় বলল, “পেন্নাম হই কর্তামশাই। আপনার তো বেশ ঝাট যাচ্ছে দেখছি।”