রুইতন হেসে বলল, “ওসব তো নবুদার বানানো গল্প। আমরা
নবুদাকে জিজ্ঞেস করায় বলল, দূর দূর! ভূতনাথটা কর্তাবাবুর কাছে গুল মারছিল বলে ওকে ভড়কে দেওয়ার জন্য বলেছি।”
ভূতনাথ অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু কর্তাবাবুও যে নবুদাদার কথায় সায় দিলেন!”
“নবুদার সব কথাতেই বাবা সায় দেয়। নবুদা হল বাবার মন্ত্রী।”
হরতন বলল, “মুখ্যমন্ত্রী, না রে দাদা?”
ভূতনাথ চিন্তিত হয়ে বলল “তা হলে তো মুশকিলেই পড়া গেল খোকাবাবুরা! ভূতের আশাতেই এতদূর আসা কিনা! কিন্তু এ বাড়িতে ভূত না থাকার তো কথা নয়! পুরনো বাড়ি, সাতপুরুষের বাস! আমার অঙ্কটা তো মিলছে না খোকাবাবুরা! ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে।”
সন্ধের পর দুই ভাই দোতলায় পড়ার ঘরে বসে লেখাপড়া করছিল। এমন সময় হঠাৎ হরতন চেঁচিয়ে উঠল, “জানালার বাইরে দিয়ে ওটা কী উড়ে গেল রে দাদা?”
রুইতন অবাক হয়ে বলল, “কী আবার উড়ে যাবে? প্যাঁচা বা বাদুড় হবে হয়তো।”
হরতন জানালার কাছে ছুটে গিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। তারপর উত্তেজিত হয়ে বলল, “দেখ দাদা দেখ, একটা লোক উড়ে বেড়াচ্ছে।”
“যাঃ,” বলে রুইতনও উঠে এল।
যা দেখল তা অবিশ্বাস্য। জ্যোৎস্না রাত্রিতে সত্যিই একটা বিরাট ফড়িঙের মতো জিনিস উড়ে বেড়াচ্ছে। তার পিঠে একটা মানুষ।
“এই দাদা, হলধরদা নয় তো?” বাগানে একটা চক্কর খেয়ে জিনিসটা সাঁ করে ফের জানালার কাছে চলে এল। ঘরের যেটুকু আলো বাইরে গিয়ে পড়েছে তাতে দেখা গেল, হলধরই বটে!হলধর একগাল হেসে তাদের দিকে চেয়ে হাত নেড়ে চেঁচাল, “মার দিয়া কেল্লা! মার দিয়া কেল্লা!”
“দেখলি দাদা!”
“সত্যিই তো!”
উড়ুক্কু ঝাঁটা ফের হুশ করে জানালার কাছে এসে ফের সাঁ করে বেরিয়ে গেল। হলধর শুধু চেঁচিয়ে বলল, “দারুণ মজা!”
দু’ভাই হাঁ করে দৃশ্যটা দেখছিল। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল ঝাঁটাটা আর একপাক ঘুরে আসতে গিয়ে হঠাৎ ফুস শব্দ করে গোত্তা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
দুই ভাই দৌড়ে নেমে ছুটে পিছনের পোড় জমিটায় গিয়ে দেখল, হলধর বসে বসে বিকৃত মুখে উঃ-আঃ করতে করতে মাজায় হাত বোলাচ্ছে।
“তোমার খুব লেগেছে হলধরদাদা?”
“তা লাগবে না? বেশ ভালই লেগেছে। তবে জিনিসটা সাকসেসফুল হওয়াতে ব্যথা তেমন টের পাচ্ছি না। কিন্তু মুশকিল কী জানো, একবার উড়ে চললে ব্যাটা বশে থাকতে চায় না। বাগ মানানো খুব মুশকিল। সেইজন্য দু-চারটে যন্ত্রপাতি লাগানো দরকার। আর একটা অসুবিধে হল সরু লাঠির ওপর বসে থাকা কিন্তু বেশ কঠিন ব্যাপার। ভাবছি একটা সাইকেলের সিট বা ঘোড়ার জিন লাগিয়ে নেব।”
হরতন বলল, “তা হলে দুটো লাগিও। একটায় তুমি বসবে, আর একটায় আমি আর দাদা।”
“হ্যাঁ, হবে হবে, সব হবে। একবার আবিষ্কারটা যখন হয়ে গেছে তখন বাদবাকি ব্যবস্থা করা শক্ত নয়। এখন কাজ হল, ওই নরদানবের হাত থেকে জিনিসটাকে রক্ষা করা।”
হরতন বলে উঠল, “আচ্ছা হলধরদাদা, ভূতনাথদা যে বলছিল তোমাকে একটা নরখাদক খেয়ে ফেলেছে! তুমি ভূত হয়ে আসোনি তো!”
মুখটা ব্যথায় বিকৃত করে হলধর বলল, “না রে ভাই, এখনও ভূত হইনি, তবে হওয়া বিচিত্র নয়। নরদানবটা তো আমাকে নিকেশ করতেই এসেছে। সারাদিন বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে ছিলুম। কী মশা রে ভাই সেখানে! পিঁপড়েও কামড়েছে অনেক। তবে কষ্ট সার্থক। চাট্টি মুড়িটুড়ি এনে দেবে খোকারা? বড্ড খিদে।”
দুই ভাই দৌড়ে গিয়ে মুড়ি নিয়ে এল। মুড়ি খেতে খেতে হলধর বলল, “আচ্ছা থোকারা, ঝাঁটায় চড়ে উড়ে বেড়ানোর সময় ছাদে একজন বিধবা থান পরা মেয়েছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম। তার হাতে একটা খ্যাংরা ঝাঁটা। তিনি কে বলো তো! এই বাড়িতে বিধবা তো কেউ নেই!”
রুইতন মাথা নেড়ে বলল, “জানি না তো?”
“শুধু তাই নয়, আরও দেখলুম, পিছনের বারান্দায় একজন বুড়ো মানুষ খুব পায়চারি করছেন। হাতে মোটা লাঠি। তাঁর সাদা গোঁফ। ঠিক চিনতে পারলুম না। কে জানো?”
রুইতন বলল, “না তো!”
“তা হলে কি ভুল দেখলুম? তা তো হতে পারে না। আমার। চোখের দোষ নেই। আরও একটা কথা।”
“কী?”
“তোমাদের বাড়ির পিছনে ওই মস্ত আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে যে পুরনো দেউড়িটা রয়েছে, তার বন্ধ ফটকের বাইরে চারজন যামার্কা লোক দাঁড়িয়ে কী যেন গুজগুজ ফুসফুস করছিল। চোর ডাকাত হতে পারে। নবুদাদাকে একটু সাবধান করে দিও। আমি এখন আমার বাঁশঝাড়ে ফিরে যাচ্ছি।”
হরতন বলল, “কিন্তু বাঁশঝাড়ে তুমি শোবে কোথায়?”
“বাঁশপাতা পড়ে পড়ে সেখানে পুরু গদির মতো হয়ে আছে। শুয়ে ভারী আরাম।”
সন্ধের পর বাড়িটা একদম সুনসান হয়ে যায়। বাড়ির ঝি চাকররা বেশিরভাগই সন্ধের পর বাড়ি চলে গেছে। শুধু রান্নার ঠাকুর আর দু’জন জোগালি একতলার রান্নাঘরে কাজকর্ম করছে। গিন্নিমা শোয়ার ঘরে, কর্তামশাই বৈঠকখানায়, রুইতন আর হরতন পড়ার ঘরে। বিশাল দোতলাটা এ সময়ে হাঁ হাঁ করে।
ছাদে ওঠার সিঁড়ির নীচে ঘুপচি জায়গাটায় বসে নবকৃষ্ণ কর্তামশাইয়ের জন্য একমনে তামাক সাজছিল। টিকে ধরিয়ে ফুঁ দিয়ে সবে আগুনটাকে ধিইয়ে তুলেছে, ঠিক এমন সময় কে যেন বলল, “ওটা কিন্তু তোর খুব খারাপ ওভ্যেস।”
নবকৃষ্ণ যখন যে কাজ করে তাতেই অখণ্ড মনোযোগ, তাই আনমনে বলল, “কোন ওভ্যেসটা?”
“ওই যে ফুঁ দিয়ে কলকে ধরাস! ফুঁ দিলে যে জিনিসটা এঁটো হয় সে খেয়াল আছে? কবে যে তোদের আক্কেল হবে কে জানে! বাছাকে আমার এঁটোকাঁটা খাওয়াচ্ছিস, তাতে কি তোর ভাল হবে?”