লজ্জা পেয়ে রাঘববাবু বললেন, “না, না, সেটা ধর্মত, ন্যায্যত ঠিক হবে না। তোমার জন্য তো আমি তেমন কিছু করিনি যে, এত দামি জিনিসটা তুমি আমাকে এমনি দিয়ে ফেলবে!”
চোখ বড় বড় করে গোলাপ বলল, “করেননি মানে? হোক ঘ্যাঁট, হোক জলের মতো পাতলা ডাল, হোক পেঁপের ঝোল, তবু তা খেয়ে তো আমার প্রাণরক্ষা হয়েছে মশাই, প্রাণের চেয়ে দামি জিনিস আর কী আছে বলুন! তবে হ্যাঁ, বিবেক দংশন বলেও একটা ব্যাপার আছে। বিবেক হল কাঠপিঁপড়ের মতো। নচ্ছারটা জামাকাপড়ের মধ্যে কোথায় ঢুকে লুকিয়ে থাকে কে জানে! তারপর সময়মতো এমন কামড়ায় যে, কহতব্য নয়। আপনার হয়তো তখন মনে হবে, আহা, গোলাপ বেচারাকে শুধু পেঁপের ঝোল আর ঘ্যাঁট আর ডাল খাইয়েই বিদেয় করলুম, আর সে আমার কত বড় উপকারটা করে গেল।”
রাঘববাবু সোৎসাহে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ তো! কাঠপিঁপড়ের কামড় আমি খুব চিনি।”
“তাই বলছিলুম কামশাই, ও জিনিসের দাম তো আর আপনার কাছ থেকে আমি নিতে পারি না! টাকাপয়সায় ওর দামও হয় না। তবু ওই বিবেক হতচ্ছাড়ার হাত থেকে বাঁচতে হলে দশ বিশ হাজার যা পারেন দিলেই চলবে। দামটাম নয়, নিতান্তই বিবেকের মুখ আটকে রাখা আর কী। একরকম বন্ধক রাখা বলেই মনে করুন। আপনার কাছে আমার পাথর বন্ধক রইল, আর আমার কাছে আপনার বিবেক।”
রাঘববাবু করুণ মুখ করে বললেন, “সবই তো বুঝলুম বাপু। মনে হচ্ছে তুমি ন্যায্য কথাই বলছ। কিন্তু বিধু স্যাকরাকে একবার পাথরটা না দেখিয়ে তো টাকাটা ফেলতে পারি না। একবার একটা লোক যে পোখরাজ বলে কাঁচ গছিয়ে গিয়েছিল।”
হাঃ হাঃ করে হেসে গোলাপ বলল, “বিধু স্যাঁকরা? কর্তামশাই, আমার অনেক দোষ থাকতে পারে, কিন্তু অকৃতজ্ঞ নই। আপনি অন্নদাতা, আশ্রয়দাতা। ও জিনিসের কোনও দাম আমি আপনার কাছ থেকে নিতে পারব না। ও আপনি এমনিই রেখে দিন। শুধু দয়া করে বিধু স্যাকরাকে ডেকে পাঁচ কান করবেন না। একটু সাবধানে রাখবেন এই অনুরোধ।”
রাঘববাবু ফের একটু দোনোমোনো করে বললেন, “সাবধানে রাখতে বলছ! কোথায় রাখা যায় তাই ভাবছি।”
“কেন কর্তামশাই, গোপন কুঠুরি বা চোরা সিন্দুক নেই?” লজ্জা পেয়ে রাঘববাবু বললেন, “তা আছে বটে।”
“তবে চলুন, আমিই দেখিয়ে দিচ্ছি ঠিক কোথায় রাখলে জিনিসটা নিরাপদ থাকবে।”
“বলছ! তবে চলো।”
অন্দরমহলের দরদালান পেরিয়ে বাঁ দিকে মস্ত ঠাকুরঘর। সেই ঘরে ঠাকুরের সিংহাসনের আড়ালে একটা ছোট্ট চৌখুপির মতো গুপ্ত দরজা। সেটা চাবি দিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকলেন রাঘববাবু। হাতে টর্চ, পিছনে গোলাপ রায়।
গুপ্ত কক্ষের ভিতরে অন্তত সাতখানা সিন্দুক। পুরু ইস্পাতের তৈরি, মজবুত জিনিস।
দেখেশুনে গোলাপ বলল, “না, ব্যবস্থা খুব একটা খারাপ নয়।”
“খারাপ নয় বলছ!”
“মোটামুটি ভালই। এবার একে একে সিন্দুকগুলো খুলে একটু টর্চটা ফোকাস করে ধরুন দেখি। কোথায় রাখলে সুবিধে হয় একটু পরীক্ষা করে দেখি।”
তা খুললেন রাঘববাবু। প্রত্যেক সিন্দুকেই বিস্তর ছোট বাক্স। তাতে সোনাদানা, টাকাপয়সা, হিরে-জহরত।
দেখেশুনে বাঁ ধারের মাঝখানের সিন্দুকটাই পছন্দ হল গোলাপের। বলল, “এটা মন্দ নয় মনে হচ্ছে। ইস্পাতটা পুরু আছে, তা ছাড়া তিনটে চাবিতে খোলে। না কর্তামশাই, এটাতেই রাখুন।”
রাঘববাবু পাথরটা সাবধানে একটা বাক্সে রেখে সিন্দুক বন্ধ করে বললেন, “বলি ওহে গোলাপ!”
“বলুন কর্তামশাই।”
“বলছিলাম কী, সত্যিই যদি তুমি মরেটরে যাও, তা হলে তো পাথরটা আমারই হবে, না কি?”
“যে আজ্ঞে। গোলাপ রায়ের কথার কোনও নড়চড় হয় না।”
“কিন্তু বাপু, তা হলে যে আমি তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব। সেটা কি ভাল দেখাবে?”
“তা কেন কর্তামশাই, আপনার কাছেও তো আমার কিছু ঋণ আছে। ধরুন খাওয়া থাকা বাবদ হিসেব করলে দিনে যদি সাড়ে তেরো টাকাও ধরেন তা হলে গত তেতাল্লিশ দিনে দাঁড়াচ্ছে একুনে পাঁচশো আশি টাকা পঞ্চাশ পয়সা। সেটা কি কম হল কর্তামশাই? তবে আপনার বিবেকের দায়িত্বটা আর আমার ওপর অর্শাচ্ছে না।”
একটু লাজুক মুখে রাঘব কয়েকখানা নোট নিয়ে বললেন, “নাও হে, একটা রাখো। দু’হাজার আছে।”
যেন ছ্যাঁকা খেয়ে হাতটা টেনে নিয়ে গোলাপ বলল, “করেন কী কর্তা! ও টাকা আপনি বরং কাঙাল ভিখিরিদের বিলিয়ে দেবেন। আমার অন্তিমকাল তো ধাঁ করে চলেই এল প্রায়। এখন আর টাকাপয়সা দিয়ে হবেই বা কী?”
“আহা, আচ্ছা না হয় পাঁচ হাজারই দিচ্ছি। নাও হে, এ দিয়ে ভাল মন্দ কিছু খেও।”
মাথা নেড়ে গোলাপ বলল, “আর লজ্জা দেবেন না কর্তা। তবে একটা কথা বলি।”
“কী বলবে হে?”
“গন্ধে গন্ধে কদম কোঙার ঠিক জায়গায় এসেছে বটে, কিন্তু এত জনের মধ্যে কোনটা আমি তা কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনি। তবে বেশি দিন তো আর ছদ্মবেশ রাখা যাবে না। কিন্তু কতদিন আয়ু আছে তা
বুঝে খোরাকির টাকা নিই কী করে। ধরুন যদি আরও এক মাস বেঁচে থাকতে হয় তা হলে এ-বাজারে পাঁচ হাজারে কি ভালমন্দ খাওয়া চলবে?”
“আচ্ছা আচ্ছা, পুরো দশই দিচ্ছি। দয়া করে নাও ভাই।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোলাপ বলল, “আপনাকে দুঃখও দিতে পারি না কি না। দিচ্ছেন দিন। তবে যদি বেঁচে ফিরে আসি তা হলে এ-টাকার ডবল ফেরত দিয়ে পাথর নিয়ে যাব। ওটা এক মাসের সুদ বলে ধরবেন। দু’মাস হলে ত্রিশ হাজার, তিন মাস হলে চল্লিশ, এরকম রেটেই টাকা আপনার বাড়তে থাকবে।”