রাঘব অবাক হয়ে বললেন, “কেন হে, তোমাকে নিকেশ করতে চায় কেন?”
“তাদের দোষ নেই কর্তামশাই, কারও বাড়া ভাতে ছাই দিলে বা মুখের গ্রাস কেড়ে নিলে নিকেশ তো করতে চাইবেই। গোলাপ রায়
যে তাদের পথের কাঁটা!”
“কেন হে, তুমি করেছটা কী?”
“সেটা আর ভেঙে বলতে বলবেন না কর্তামশাই। আমার বড় বিপদ। দু-চারদিনের মধ্যেই একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে।
আর সেইজন্যই আপনার কাছে আসা।”
“তা বাপু, বিপদ বুঝলে পুলিশের কাছে যাচ্ছ না কেন? আমাদের গিরিধারী দারোগা তো দাপটের লোক।”
একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে গোলাপ বলল, “দারোগা পুলিশের কর্ম নয় কর্তামশাই। সাধারণ চোর-ডাকাত-খুনি হলে কি আর ভাবনা ছিল! আপনার আশীর্বাদে ওসব ছোটখাটো অপরাধী গোলাপ রায়ের হাতের ময়লা। কিন্তু এরা অনেক উঁচু থাকের লোক। মকরধ্বজের উলটো গ্রহই হল চ্যবনপ্রাশ, সেখানে গিজগিজ করছে সব প্রতিভাবান শয়তান। তাদের সঙ্গে এঁটে ওঠা দায়! ফলে যে গন্ধমাদনটি এসেছে তাকে লক্ষ করেছেন তো? দেখবেন ডান কানটা বাঁ কানের চেয়ে ছোট। ওটাই হল চ্যবনপ্রাশের লোকদের লক্ষণ। কালও বুঝতে পারিনি বটে, কিন্তু আজ সকালের আলোয় ভাল করে লক্ষ করেই বুঝলাম, আমার শমন এসে গেছে।”
“কদম কোঙারের কথা বলছ নাকি হে? কিন্তু সে তো একজন সামান্য লেঠেল।”
“তাই বলেছে বুঝি? তা অমন কত কথাই বলবে। আসল কথা হল, লোকটা এসে গেছে। এখন হয় ও মরবে, না হয় আমি। আর সেইজন্য আপনার কাছে আসা।”
“তাই তো! তুমি তো বেশ চিন্তায় ফেলে দিলে হে!”
“নিজের প্রাণটা হাতে নিয়ে লোফালুফি করেই তো আমাকে বেঁচে থাকতে হয় কর্তামশাই! তাই বলছিলুম, গোলাপ রায় মরেছে শুনলেও দুঃখ করবেন না। এরকম কত প্রতিভাই তো অকালে নষ্ট হয়ে যায়। সব কুঁড়িতেই কি ফুল ফোটে, না কি সব বৌলেই আম হয়। আপনাদের কোন কবি যেন বলেছেন, যে-নদী মরুপথে হারাল ধারা? এ হল সেই বৃত্তান্ত।”
“তা বাপু, এর কি কোনও বিহিত নেই? আমরা পাঁচজন থাকতে তোমাকে তো বেঘোরে মরতে দেওয়া যায় না।”
সবেগে মাথা নেড়ে গোলাপ বলল, “না কর্তামশাই, আমার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে আপনারা কেন বিপদ ডেকে আনবেন? ও কাজও করবেন না। ছাতা দিয়ে কি বজ্রাঘাত ঠেকানো যায় মশাই? শোলা দিয়ে তো আর লোহা কাটা যায় না! কখনও কি শুনেছেন ছুঁচ দিয়ে কেউ বাঘ মেরেছে?”
রাঘববাবু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “তা অবশ্য শুনিনি।”
“তবে! চ্যবনপ্রাশের নামই দেওয়া হয়েছে গুণ্ডা গ্রহ। সেখানে গণ্ডায় গণ্ডায় গুণ্ডা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে চার কদম হাঁটতে না হাঁটতেই চারটে খুন, সাতটা রাহাজানি, বারোটা ছিনতাই দেখতে পাবেন। আর গুণ্ডাদের চেহারাই বা কী, মনে হবে সাতটা মহিষাসুরকে চটকে মেখে নিয়ে এক-একটা গুণ্ডা তৈরি করা হয়েছে। তাদের তুলনায় কদম কোঙার তো নস্যি। তাকে চ্যবনপ্রাশের কুলাঙ্গারই বলতে পারেন। তবু তারই এলেমটা দেখুন। কাল রাতে সে ওই অতবড় লাশ হাবু দাসকে নেংটি ইঁদুরের মতো তুলে আছাড় মেরেছে। গুণেন গায়েনকে পিঁপড়ের মতো টোকা
মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।”
“বলো কী? কই কেউ তো আমাকে এসব জানায়নি!”
“আজ্ঞে, কার ঘাড়ে ক’টা মাথা? আপনারও জানার দরকার নেই। মনে করে নিন, কথাটা আমি বলিনি, আপনিও শোনেননি।”
“তাই তো হে! আমার বিপদে তো দেখছি ঘরে ঢোকার আগে পাপোশে পা মুছছে।”
“যে আজ্ঞে। কড়া নাড়া দিতে আর দেরি নেই। আর সেইজন্যই গা-ঢাকা দিয়ে আপনার কাছে আসা। হাট গোবিন্দপুর থেকে তল্পিতল্পা গোটানোর আগে আপনার কাছে একটা জিনিস গচ্ছিত রেখে যেতে চাই।”
“কী জিনিস বলো তো!”
“এই যে!” বলে ট্যাঁক থেকে একটা কাগজের মোড়ক বের করল গোলাপ রায়। সাবধানে পুরিয়াটা খুলে জিনিসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “বড্ড দামি জিনিস কর্তামশাই। এই ছোট্ট জিনিসটার জন্যই এতদূর থেকে ধাওয়া করে এসেছে কদম কোঙার।”
রাঘববাবু দেখলেন, মোড়কের মধ্যে একটা ছোট পাথর। মটরদানা সাইজ। রংটা লালচে।
“এটা কী পাথর হে? চুনি নাকি?”
হেঃ হেঃ করে হেসে উঠল গোলাপ। বলল, “চুনি! কী যে বলেন কর্তামশাই। আমাদের মকরধ্বজে যে মোরামের রাস্তাগুলো আছে। সেগুলো তো চুনির গুঁড়ো দিয়েই তৈরি হয়। যদি হিরের কথা বলেন তা হলে বলি, মকরধ্বজের পথেঘাটে মাটির ঢেলার মতো হিরে পড়ে থাকে, বাচ্চারা কুড়িয়ে নিয়ে ঢিল মেরে মেরে আম পাড়ে। আর পান্না! আমাদের চার-চারটে পাহাড় আছে আগাগোড়া পান্না দিয়ে তৈরি। না কর্তামশাই, না। এ চুনিটুনি নয়। সারা বিশ্বজগতে চার-পাঁচখানার বেশিই নেই। এ যার দখলে থাকবে, সে কুবেরকে চাকর রাখতে পারবে।”
“বটে!”
“একটু সাবধানে রাখতে হবে কর্তামশাই, কেউ টের না পায়।”
রাঘব দোনোমোনো করে বললেন, “এত দামি জিনিস বলছ। তা এটা রাখা কি ঠিক হবে?”
“কর্তামশাই, একথা ঠিক যে, রাহুর পিছু পিছু কেতুও ঘুরে বেড়ায়। কাজেই এ জিনিসের পিছু পিছু যে বিপদও ঘুরে বেড়াবে তাতে আর সন্দেহ কী? তবে আমার তো চালচুলো নেই, তার ওপর কবে যে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায় তার ঠিক কী? তখন যে এই কুবেরের ধন বেওয়ারিশ পড়ে থাকবে, নইলে শত্রুপক্ষের হস্তগত হবে। আমি বলি কী, আপনার কাছেই থাক। যদি আমি পটল তুলি তা হলে এটা আপনারই হয়ে গেল, তবু ভাবব একজন সজ্জনের ভোগে লেগেছে।”