“কিন্তু আপনিও মনে রাখবেন, যত বড় হও, তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড় নও। আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়, এই কথা বলে যাব আমি চলে। গুডবাই কর্তামশাই।”
উদ্যত ঠ্যাঙার সামনে অসহায় হুলো। রাঘববাবুর চোখে জিঘাংসা, হুলোর মুখে আর্তি। ঠিক এই নাটকীয় মুহূর্তে হঠাৎ রাঘববাবুর বাঁ কানটা সুড়সুড় করে উঠল। তারপর ফিসফিস করতে লাগল। বিপদ! বিপদ! ফিসফিসের পর থিরথির। তারপর একেবারে থরথর করে কেঁপে উঠল রাঘববাবুর বাঁ কান। তিনি ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। লক্ষণটা যে তাঁর খুবই চেনা। তাঁর শিথিল হাত থেকে ঠাস করে ঠ্যাঙাটা খসে পড়ল। তিনি ধীর পায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।
হুলো দু’খানা মাছ মুখে নিয়ে এক লাফে বেরিয়ে এসে দোতলার বারান্দার রেলিং টপকে পাশের দেওয়ালের ওপর গিয়ে উঠে পড়ল এবং সেখান থেকে রাঘববাবুর উদ্দেশে নানারকম ব্যঙ্গবিদ্রূপ বর্ষণ করতে লাগল। কিন্তু আজ আর সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না রাঘববাবু। সোজা বৈঠকখানায় এসে ধপ করে নিজের গদি-আঁটা চেয়ারখানায় বসে খুব গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন।
ভাবনারই কথা কিনা। দুনিয়ায় অনেক ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। যেমন, হয়তো রাত্রে রোদ উঠল, আর দিনে জ্যোৎস্না। জলের মাছ আকাশে উড়তে লাগল, চড়াইপাখি গিয়ে বাসা বাঁধল পুকুরের জলে। এমনও হয়তো দেখা যাবে যে, গ্রীষ্মকালে দুর্গাপুজো, মাঘ মাসে রথ আর ফায়ূনে অম্বুবাচী হচ্ছে। কে জানে হয়তো জষ্টিমাসে লোকে লেপ গায়ে দেবে, পৌষমাসে হাতপাখা নেড়ে খাবে বরফজল। ডাঙায় এরোপ্লেন ঘুরে বেড়ালে, আর আকাশে গোরুর গাড়ি উড়লেও অবিশ্বাসের কিছু নেই। কিন্তু তা। বলে রাঘববাবুর বাঁ কানের কথা কিন্তু মিথ্যে হওয়ার নয়। বিপদ আসছে। তবে সেটা কোথা দিয়ে কী রূপ ধরে আসে, সেটাই চিন্তার কথা।
আনমনে হাত বাড়াতেই তামাকের নলটা তাঁর হাতে চলে এল।
কিছুক্ষণ খুব নিবিড়ভাবে তামাক খেলেন রাঘববাবু। তারপর আপনমনে বলে উঠলেন, “খুবই চিন্তার কথা!”
সঙ্গে-সঙ্গে একটা প্রতিধ্বনি হল, “খুবই চিন্তার কথা।”
প্রতিধ্বনি শুনে একটু অবাক হলেন রাঘববাবু। কোথাও কোথাও প্রতিধ্বনি হয়, একথা তিনি জানেন। তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু তাঁর যতদূর মনে পড়ছে এই বৈঠকখানায় তিনি কখনও প্রতিধ্বনি শোনেননি। তবে কি এতকাল ব্যাপারটা খেয়াল করেননি তিনি! একটু অবাক হয়ে নিজের হাতের তামাকের নলটিও দেখলেন রাঘববাবু। যতদূর জানেন, নবকৃষ্ণ বাড়ির লেপলোশক রোদে দিতে ছাদে বহাল আছে। সুতরাং নবকৃষ্ণর পক্ষে তামাক সেজে দেওয়া সম্ভব নয়। আর নবকৃষ্ণ ছাড়া তাঁর তামাক সাজার হুকুম আর কারও ওপর নেই। অথচ তিনি দিব্যি তামাক খাচ্ছেন! আরও একটু অবাক হয়ে তিনি হাতের নলটার দিকে চেয়ে বলে উঠলেন, “আমি তামাক খাচ্ছি!”
“আজ্ঞে, তামাক বলেই তো মনে হচ্ছে। অম্বুরি তামাকের গন্ধটাও ছেড়েছে ভাল।”
এবার সচকিত হয়ে পিছনে তাকিয়ে তিনি লোকটাকে দেখতে পেলেন। হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “তুমি কে বলল তো!”
“আজ্ঞে, অধমের নাম গোলাপ রায়। আপনারই চরণাশ্রিত। কর্তা কি চিনতে পারছেন না আমাকে?”
রাঘববাবু মাথাটাথা চুলকে বললেন, “কী জানো, এত লোক আমার চরণাশ্রিত যে, তাদের সবাইকে মনে রাখা মুশকিল।”
“তা তো হতেই পারে। আমি হলুম গে মকরধ্বজের গোলাপ রায়। বেশি নয়, মাত্র আড়াই লক্ষ লাইট ইয়ার দূরের লোক।”
“ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা বাপু, এখানে তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো! সব ঠিক আছে তো!”
“যে আজ্ঞে, অসুবিধে যা আছে তা গায়ে না মাখলেই হল। ধরুন, মকরধ্বজে আমরা সকালে জিলিপি আর লুচির জলখাবার খেতুম, এখানে রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট। মকরধ্বজে দুপুরে পোলাও মাংস আর পায়েস বাঁধা ছিল, এখানে ডাল ভাত ঘ্যাঁট আর মাছের ঝোল। আরও শুনবেন কি কর্তামশাই?”
“তা শুনতে তো মন্দ লাগবে না, বলে ফেলো।”
“রাতের খাবারটা মকরধ্বজে একটু ভারী রকমেরই হয়। একেবারে মোগলাই। বিরিয়ানির সঙ্গে তন্দুরি মুর্গি, পাকা মাছের কালিয়া, রোগন জুস, রেজালা, আলুবখরার চাটনি আর ক্ষীর। ফাঁকে ফাঁকে ছোটখাটো পদও থাকে। তা সেগুলোর কথা বলে আর ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব না। সে তুলনায় এখানে রাতের খাবারটা বেশ হালকা, পেঁপের ঝোল আর ভাত।”
“তা হলে তো তোমার এখানে বেশ অসুবিধেই হচ্ছে হে!”
“না, কর্তামশাই, অসুবিধে কীসের? কথায় আছে পড়েছ মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। যখন যেমন, তখন তেমন। গুরুভোজন বাদ যাওয়ায় পেটের বিশ্রামও তো হচ্ছে।”
“তা বটে। তবে বাপু, তোমার তামাক সাজার হাতটা বেশ ভাল, বলতে কী আমাদের নবকৃষ্ণও এত ভাল সাজতে পারে না।”
“ওকথা বলে আর লজ্জা দেবেন না। দুটো কাজের কথা কইতে এসে দেখি আপনি খুব ভাবনায় পড়েছেন। তাই ভাবলুম ভাবনাচিন্তা করার সময় তামাক খুব কাজ দেয়।”
“বাঃ বাঃ, তোমার মাথায় তো বেশ ভাল ভাল ভাবনা আসে!”
মুখোনা করুণ করে গোলাপ রায় বলল, “আজ্ঞে, ওইটেই হয়েছে মুশকিল, মাথাই যে আমার শত্তুর। ভাল ভাল ভাবনাচিন্তা, মাপজোক আসে বলে এ মাথার জন্য লোকে লাখো লাখো টাকা দাম দিতে চায় বটে, কিন্তু তাতে শত্রুপক্ষের তো খুশি হওয়ার কথা নয়।
তাই তারা চায় আমাকে নিকেশ করতে। কর্তামশাই, ভাল মাথার যেমন দাম আছে, তেমনি আবার গুনোগারও আছে।”