“ওরে না। সে কথা নয়। সেসব তো রোজই খায়। তবু যেন আজ দুধটা একটু বেশিই দিয়ে ফেলছে!”
“কিউ নেহি বাবু? মুলতানি গাই আছে, যত খিলাবেন তত দুধ বাড়িয়ে যাবে। কাল রাঘববাবু তো ইসকো দো সের রসগুল্লা ভি খাইয়েছেন। উসি লিয়ে দুধ জেয়াদা দিচ্ছে।”
কথাটা মোটেই মনঃপূত হল না গুণেনের। ও ব্যাটা আসল ব্যাপারটা বুঝতেই পারেনি। কিন্তু গুণেন গোরুটাকে ভাল করে লক্ষ করে দেখল, মুখটা বেশ হাসি-হাসি। আর চোখে কেমন একটা বিভোর ভাব। অবোলা জীব, কথা তো আর কইতে পারে না, কিন্তু গুণমুগ্ধ চোখে গুণেনের দিকে চেয়ে আছে।
“হ্যাঁ রে গেনু, তুই গানবাজনা ভালবাসিস?”
“হাঁ হাঁ, জরুর। গান বাজনা তো হামার বহুত পসন্দ আছে। রোজ রাতে তো আমি ঢোল বাজাই আর রামা হো, রামা হো গানা ভি গাই।”
“ও গান নয় রে। এই যে একটু আগে আমি আলাহিয়া বিলাওল গাইলাম, শুনিসনি?”
“কাহে নেহি শুনবে বাবু? জরুর শুনেছে। উ তো বহুৎ উমদা গানা আছে বাবুজী। শুনে আমার দাদিমার কথা ইয়াদ হল।”
“কেন রে, তোর দিদিমার কথা মনে পড়ল কেন? তোর দিদিমা গান গাইত বুঝি?”
“নেহি বাবু, দাদিমা থোড়াই গান গাইবে। লেকিন হামার দাদিমা রোতা থা। কুছু হলেই দাদিমা কাঁদতে বইসে যেত। গরম পড়লে কাঁদত, শীত পড়লে কাঁদত, বরখ হলে কাঁদত। কাক বক মরলে কাঁদত। এইসন কাঁদত যে আশপাশ গাঁওমে কোই মারাটারা গেলে দাদিমাকে ভাড়া করে কাঁদবার জন্য নিয়ে যেত। আপনার গান শুনে হামার খুব দাদিমার কথা ইয়াদ হচ্ছে।”
ধুস! ব্যাটা গানের কিছুই বোঝে না। সমঝদার না হলে এইসব উচ্চাঙ্গের জিনিস বুঝবেই বা কে?
তবে খানিকটা দমে গেলেও আশার আলোও যে দেখা গেল না তা নয়। বুড়ো খাজাঞ্চি খগেন দফাদার তো গুণেনকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, “আহা, কী গানই না গাইলে হে গুণেন! কোনওকালে আমি কালোয়াতি গান পছন্দ করিনি। বরাবর মনে হয়েছে ও হল গলাবাজি করে সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করা। তা বাপু, তোমার গান শুনে দেখলুম এ গান খুবই উপকারী জিনিস।”
গুণেন সোৎসাহে বলল, “বটে! তা কী হল খাজাঞ্চিমশাই!”
“কাল পুকুরে চান করতে গিয়ে ডান কানে জল ঢুকে গিয়েছিল। কিছুতেই বেরোয় না। সারাদিন কান টনটন করেছে। খড়কে দিয়ে খুঁচিয়ে, তুলোর ঢিপলি ঠেসেও জল বের করা যায়নি। তারপর রাত্তিরে তোমার গান শুনে কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে বসে যখন তোমাকে শাপ শাপান্ত করছি, তখনই অবাক কাণ্ড হে! গানের ধাক্কায় কানের জল সুড়সুড় করে বেরিয়ে এল। সে যে কী আরাম, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। চালিয়ে যাও হে, তোমার হবে।”
আনন্দে ডগমগ হয়ে গুণেন তার গানের আর কী কী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হল তা দেখতে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল।
“এই যে ভাইটি!”
সামনে পর্বতপ্রমাণ হাবুদাসকে দেখে গুণেন হাসি-হাসি মুখ করে দাঁড়াল। হাবু দাসের চোখমুখে ভাবের খেলা দেখেই সে বুঝেছে গানের সম্মোহনে হাবু সমাচ্ছন্ন।
হাবু দাস ফিচিক করে হেসে বলল, “তোমাকে একটা মজার ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি। ভেবেচিন্তে বলো তো দেখি। এই আমার নাম যদি হাবু হয়, পাঁচুর নাম যদি হয় পাঁচু, গোলাপ রায়ের নাম যদি হয় গোলাপ রায়, এবাড়িটা যদি রাঘববাবুর হয়, আর এ গাঁয়ের নাম যদি হয় হাট গোবিন্দপুর, তা হলে তোমার নামটা কী হবে?”
“অ্যাঁ।”
“হ্যাঁ, খুব সোজা অঙ্ক। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করলেই বেরিয়ে পড়বে। তাড়া নেই, ভেবেচিন্তে বলল তো!”
গুণেন হাঁ হয়ে গেল। বলল, “তার মানে?” খিকখিক করে হেসে হাবু বলল, “পারলে না তো! দুয়ো, দুয়ো।”
বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল। তার গানের প্রভাবে যে চারদিকে নানারকমের পরিবর্তন হয়েছে সে বিষয়ে গুণেনের সন্দেহ রইল না। কিন্তু দুনিয়াটা এতটা বদলে যাওয়া কি ভাল?
গুণেন হঠাৎ থমকে গেল। তাই তো! হাবু তো কিছু ভুল বলেনি। বাস্তবিক হঠাৎ এখন খেয়াল হল, নিজের নামটা তো সত্যিই মনে পড়ছে না! কী যেন নামটা তার!
৩. রাঘববাবুর বাঁ কান কাঁপলে
রাঘববাবুর বাঁ কান কাঁপলেই বুঝতে হবে বিপদ আসছে। তেরো বছর আগে যখন প্রথমবার তাঁর বাঁ কান কেঁপেছিল সেবারই শ্বশুরবাড়িতে কাঁঠাল খেয়ে তাঁর কলেরা হয়। বছর দুই বাদে ফের একদিন বাঁ কান কেঁপে উঠেছিল, আর সেবারই হিমে ডাকাত হানা দিয়ে তাঁর টাকাপয়সা সোনাদানা সব চেঁছেছে নিয়ে তো যায়ই, উপরন্তু রাঘববাবুর খুড়োমশাই অবসরপ্রাপ্ত দেশনেতা মাধব চৌধুরী ডাকাতির সময় ডাকাতদের উদ্দেশ্যে দেশের নৈতিক অধঃপতন বিষয়ে একটা সময়োচিত নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিচ্ছিলেন বলে তাঁর পেটে একটা বল্লমের খোঁচাও মেরে যায়। সেই খোঁচা থেকেই কিনা কে জানে, খুড়োমশাই বাকি জীবন অম্লশূলে ভুগেছেন। এই ঘটনার চার বছর বাদে ফের এক সকালে রাঘববাবুর বাঁ কান নেচে উঠল এবং সেবার বাড়ির উঠোনে ‘নদের নিমাই’ যাত্রার আসরে ঝাড়বাতি ভেঙে পড়ে শচীমাতার নাক ফেটে গিয়েছিল বলে তিনি মামলা করে রাঘববাবুর কাছ থেকে মোটা খেসারত আদায় করেছিলেন। কারণ নাক ফেটে যাওয়ায় তিনি নাকি আর নাকিসুরে বিলাপ করতে পারতেন না এবং নাকিসুরের বিলাপ ছাড়া শচীমাতার পার্টে আর থাকেটা কী? এই তো বছরতিনেক আগে ফের ঘুমন্ত বাঁ কান হঠাৎ জেগে উঠেনড়াচড়া করে উঠল। সেবার বেয়াই রামশরণ সমাদ্দারের সঙ্গে দাবা খেলার সময় একটা কাঠপিঁপড়ে কামড়ে দেওয়ায় আত্মবিস্মৃত হয়ে রাঘববাবু ভুল করে মন্ত্রীকে আড়াই ঘরের চালে চেলে ফেলেছিলেন। এবং তাতে রামশরণের একটা বিপদজ্জনক গজ মারা পড়ে। রামশরণ সেটা বুঝতেও পারেননি। কিন্তু তাঁর ফাজিল ভাগ্নে ফটিক ভারী নিরীহ গলায় বলেছিল, তালুইমশাইয়ের চালটা দেখলে মামা? মন্ত্রীকে যে ঘোড়ার চালেও চালানো যায় ক’টা লোকই বা তা জানে! ওঁর কাছে অনেক কিছু শেখার আছে কিন্তু। কথাটা শুনে রামশরণ সচকিত হয়ে চালটা দেখে রেগে কাঁই হয়ে জলগ্রহণ না করে রাঘববাবুর বাড়ি থেকে সেই যে চলে গেলেন আজ অবধি আর এ-মুখো হননি। বউমাকে পর্যন্ত বাপের বাড়িতে আসতে দেননি।