বাঃ, ময়নাগড়ের সব ভূতের বৃত্তান্তই তো তোমার জানা দেখছি।
বোকা লোকদের তো ওইটেই সুবিধে। যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। লেখাপড়া জানা চালাকচতুর লোকের তো তা নয়। ভূত দেখলেও নানা ফ্যাকড়া তুলে, কূটকাঁচালি করে ওটা যে ভূত নয় সেটা প্রমাণ করেই ছাড়বে। কিন্তু আপনি কে বলুন তো! আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। চেনার কথাও নয় কিনা। আমার নাম হিজিবিজি।
পাঁচু একটু ভেবে ঘাড় কাত করে বলল, বাঃ, বেশ নাম! ভুল হওয়ার জো নেই। তা এ-গাঁয়ে কাকে খুঁজছেন?
কাউকেই নয়। এ-পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম, একটু জিরিয়ে নিতে থেমেছি। তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে ভারী ভালো লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে, দুটো দিন থেকে যাই।
ভারী লজ্জা পেয়ে পাঁচু বলে, যাঃ কী যে বলেন! আমার সঙ্গে দেখা হলে সবাই তো বিরক্তই হয়। কেউ খুশি হয় না তো। অনেকে তো আমাকে দূর থেকে দেখে দরজা বন্ধ করে দেয়।
তা হলে আমিও বোধ হয় তোমার মতোই বোকা লোক, তাই তোমাকে আমার বেশ ভালো লাগছে।
পাঁচু চিন্তিত হয়ে বলে, তা-ই বা হয় কী করে? আপনাকে দেখে যে বোকা বলে মনেই হয় না। বরং মনে হয়, আপনি ভীষণ চালাক।
তা হলে তোমাকে সত্যিই কথাটাই বলি। তুমি কি জানো যে, দুনিয়ায় বোকা লোকের সংখ্যা ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে? আমি সারা দেশ চষে বেড়াই, আজ অবধি একটা খাঁটি, নীরেট বোকা লোক দেখতে পেলাম না।
পাঁচু মাথা নেড়ে বলে, সে ঠিক কথা। এ-গাঁয়েও আমি ছাড়া আর বোকা লোক নেই।
আমি আসলে বোকা লোকই খুঁজে বেড়াচ্ছি।
ভারী অবাক হয়ে পাঁচু বলে, বোকা লোক খুঁজছেন কেন?
বোকা তোক না হলে আমার কাজ-কারবারের সুবিধে হয় না কিনা। কিন্তু বোকা লোক খুঁজে বের করা ভারী শক্ত। অনেকে বোকা-বোকা ভাব করে থাকে, আসলে খুব চালাক। অনেকে আবার এক বিষয়ে বোকা তো অন্য বিষয়ে চালাক। ধরো ইংরিজিতে বোকা, অঙ্কে চালাক। আবার অনেকে আছে এত বেশি চালাক যে, চালাক লোকেরা তাদের চালাকি ধরতে না পেরে বোকা বলে ভেবে নেয়। তা তুমি এদের মতো নও তো!
মাথা নেড়ে পাঁচু বলে, তা তো জানি না। অত জানলে তো চালাকই হতাম।
হিজিবিজি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কাজটা খুব শক্ত। পাঁচু বলে, কোন কাজটা?
সত্যিকারের বোকা কিনা তা বুঝতে পারা। তোমাকেও আরও ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
ও বাবা, খাতা-কলম নিয়ে পরীক্ষায় বসতে হবে নাকি? সে কিন্তু আমি পারব না। বলেই পাঁচু অবাক হয়ে দ্যাখে, লোকটা আর তার পাশে নেই। চারদিকে চেয়ে কোথাও হিজিবিজিকে দেখতে পেল না পাঁচু। লোকটা স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে।
৩. চোরেক্কে চোর, চোর দু-গুনে টকাই
লোকে বলে, চোরেক্কে চোর, চোর দু-গুনে টকাই। তা কথাটা মিথ্যে নয়। টকাইকে শুধু চোর বললে গুণী মানুষের অমর্যাদা হয়। এই যেমন কেতুগাঁয়ের হরমন ওস্তাগর। সে কি শুধু দরজি? তা হলে তার হাতের তৈরি পায়জামা পরে রাস্তায় বেরোলে চারদিকে ঠেলাঠেলি পড়ে যায় কেন? আর কেনই বা কেয়াবাত কেয়াবাত ধ্বনি শোনা যায়, মাঝের গাঁয়ের নটবর অতি সুপুরুষ। বিয়ে করতে গেলে হরমনের তৈরি পাঞ্জাবি পরে। তা বিয়ে বাড়িতে বরকে দেখে বরের পাঞ্জাবির প্রশংসায় লোকে এমন শোরগোল তুলে ফেলল যে, নটবর বিয়ে না করেই ফেরত এসেছিল। শুধু কি তাই? হরমনের তৈরি হাফ পেন্টুল পরে কালীপুরের বিখ্যাত কাপুরুষ অভয়পদ অবধি একদিন দিব্যি নিশিদারোগার চোখে চোখ রেখে বুক ফুলিয়ে কথা কয়ে এল। পরে অবস্য ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা মনে পড়ায় সে ভিরমি খায়। গুণী মানুষের অভাব নেই এ-তল্লাটে। ওই যে খয়রাপোতার ফকির জোলা, রোগাভোগা বুড়ো মানুষ ক্ষয়াটে চেহারা, রুক্ষ দাড়ি আর পাকা চুলে তেমন আহামরি কেউ বলে মনেও হয় না। ঘরে কেঠো তাতে গামছা আর লুঙ্গি বানিয়ে বুড়ো হল। তার ওইসব লুঙ্গি আর গামছার জন্য বছরখানেক আগে থেকে আগাম দাম দিয়ে নাম লিখিয়ে রাখতে হয়। হাটের জিনিস তো নয় যে, পয়সা ফেললেই পাওয়া যাবে। ফকিরের লুঙ্গি আর গামছার সমঝদার সব নবাব-বাদশা গোছের লোক। হিল্লি-দিল্লি থেকে লোক এসে মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে যায়। এ-তল্লাটের লোক সে জিনিস চোখেও দেখতে পায় না। তবে বিক্রমগড়ের রানিমার জন্য একখানা বেনারসী বুনে দিয়েছিল ফকির। মাঘী পূর্ণিমার স্নানের দিন বেনারসীখানা পরে হাতিতে চেপে চানে যাচ্ছিলেন রানিমা। তা বেনারসীটা দেখে হাতিও নাকি সেলাম দিয়েছিল। পরে লোকে বলেছিল, রানি না রামধনু তা যেন ভালো করে বোঝাই গেল না, আহা কী রং! কী জেল্লা! চোখ সার্থক। আর তায়েবগঞ্জের মানুষখেকো বাঘের গপ্পো তো সবাই জানে। তায়েবগঞ্জের ধার ঘেঁষে খয়রাপোতার গভীর জঙ্গলের ধারে মতি পাড়ুই হারানো ছাগল দুখিয়াকে খুঁজতে গিয়ে পড়ে গেল বাঘের খপ্পরে। মতি মনের দুঃখে দুখিয়াকে ডাকতে-ডাকতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কাঁধে এসে পড়ল বিশাল একখানা থাবা। একটি থাবায় তাকে মাটিতে ফেলে বাঘ বেশ করে দিনান্তে জলযোগ সেরে নিতে সবে হাঁ করেছে, ঠিক সেই সময়েই সন্ধের মুখে একটু দূরে নিজের একডেরে ঘরটিতে বসে তমিজ মিয়া পূরবীতে তান ধরলেন। বাস, বাঘ আর কামড় বসাতেই পারল না। খানিকক্ষণ উদাস নয়নে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। হিংস্র বাঘ হয়ে গেল স্বপ্নাতুর, থাবার নখ লুকিয়ে ফেলে সেই থাবা দিয়েই চোখের জল মুছতে মুছতে ধীর পায়ে জঙ্গলে ফিরে গেল। একদিন গভীর রাতে তমিজ মিয়া দরবারি কানাডায় আলাপ ধরেছেন, সেইসময়ে তাঁর বাড়ির সামনে গালপাট্টাওয়ালা, জরির সাজ পরা একটা লোককে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে গাঁয়ের চৌকিদার রামলাখন চৌবে গিয়ে লোকটাকে চোখ রাঙিয়ে জিগ্যেস করেছিল, ক্যা রে চোট্টা, ক্যা মতলব?