তা হলে তো তোমার সময়টা খারাপই যাচ্ছে।
খুব খারাপ, বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে করছে না। মরতেই ইচ্ছে যাচ্ছে, বুঝলে! কিন্তু সনাতনদাদুর অবস্থা দেখে মরতেও ভয়-ভয় করছে।
সনাতনদাদুটা আবার কে?
সে তুমি চিনবে না। আমি তো সারা গায়ে টহল দিয়ে বেড়াই, আনাচ-কানাচ, কোনা-খামচি সব চিনি। ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত আমার মতো কেউ জানে না। গাঁয়ের শেষে পেত্নিরজলা বলে একটা মস্ত মজা দিঘি আছে, জানো তো! ধারে ফলসা বন, সেটা পেরিয়ে গিয়ে মজা দিঘির উপরে গহীন জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটা উঁচু-উঁচু ঢিবি আছে। তা, সেইসব ঢিবির একটাতে গিয়ে আমি বসে থাকতাম দুপুরবেলায়। একদিন বসে আছি, চারদিকে ঝঝ করছে চোতমাসের দুপুর, হঠাৎ যেন কাছেপিঠে একটা দরজার হুড়কো খোলার সব্দ হল। ভারী অবাক হলাম। এই জঙ্গলে তো বাড়িঘরের চিহ্নমাত্র নেই, তবে দরজা খোলে কে? তখন নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, ঢিবির তলার দিকে একটা পুরোনো কেলে দরজার কানা একটু ফাঁক করে একজন অষ্টাবক্র কৃকলাশের মতো রোগা লোক বেরিয়ে এল। পরনে একটা নেংটি গোছের, আদুড় গা। আমি যে-ই উপর থেকে কে বলে হাঁক মেরেছি, অমনি ভিতরে ঢুকে ঝপ করে দরজা সেঁটে দিল। আমি তাড়াতাড়ি নীচে গিয়ে দরজার জায়গাটা ভালো করে দেখলুম। দরজা বলে। বোঝার উপায় নেই। উপরে পুরু মাটি জমে আছে, তাতে গাছপালা গজিয়েছে। মাটি খানিক খামচে সরিয়ে দরজার কড়া পেলাম বটে, কিন্তু বিস্তর ডাকাডাকি আর টানাটানিতে দরজা খোলেনি। তারপর রোজ গিয়ে দুপুরে তক্কেতকে ঢিবির উপর বসে নজর রাখি। দিনপনেরো বাদে লোকটা ফের বেরোল। এবার আর আমি হাঁক মারিনি। সোজা দুই লাফে নেমে গিয়ে লোকটাকে জাপটে ধরেছি। কিন্তু কী আশ্চর্য কাণ্ড, ধরতেই পারলুম না, আমার হাত যেন হাওয়া কেটে ফিরে এল।
বটে? হা গো। তবে এবার আর লোকটা পালাল না। আমাকে খুব মন দিয়ে দেখল। তারপর বলল, কেন মিছে হয়রান হচ্ছিস বাবা? আমি চোর-ঘঁচোড় নই। তিনশো বছর ধরে নিজের সম্পত্তি আগলে বসে আছি। মাঝে-মাঝে একটু হাঁফ ছাড়তে বেরোই। তা তুই এখানে ছোঁকছোঁক করছিস কেন? বলতে নেই, আমি একটু ঘেবড়ে গিয়েছিলাম। তবে লোকটা তেমন খারাপ নয়। দুঃখ করে বলল, বিষয় হল বিষ। বুঝলি, ওই যে বিষয়-চিন্তা করতে-করতে পটল তুলেছিলুম, সেই থেকে আর আত্মাটার সদ্গতি হল না। ঢিবির মধ্যে সেঁধিয়েই এতগুলো বছর কেটে গেল। বাঃ, তোমার তো খুব সাহস!
ঠোঁট উলটে পাঁচু বলে, সাহসের কাজ তো কিছু নয়। এমনিতে তো গাঁয়ের লোক কেউ আমাকে মানুষ বলেই মনে করে না, কথাটথাও কয় না। হয়তো ভাবে, বোকা ছেলেটার সঙ্গে কথা কয়ে হবেটা কী? কিন্তু সনাতনদাদু সেদিক দিয়ে ভালো। অনেক কথাটথা কইল। একদিন আমাকে বাড়ির মধ্যেও নিয়ে গেল।
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, না হে, তোমার সাহস আছে। তা কী দেখলে সেখানে? পাঁচু চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, অন্ধকারে কি কিছু দেখা যায়। কয়েকটা লোহার বাক্স আছে মনে হল, তাতে বড়-বড় তালা ঝুলছে।
সে তো গুপ্তধন। তোমার লোভ হল না?
নাঃ। সনাতনদাদুর দশা দেখে আমার লোভ উবে গেল। মরার ইচ্ছেও চলে গেল।
এখনও কি সনাতনদাদুর কাছে যাও?
যাই মাঝে-মাঝে। সাতদিন ঘুমোয়, সপ্তাহে একদিন মোটে বেরোয়। গায়ে একটু রোদটোদ লাগিয়ে ফের ঢুকে যায়।
তুমি কি বুঝতে পেরেছ যে, তোমার সনাতনদাদু আসলে ভূত?
পাঁচু ফের ঠোঁট উলটে বলল, তাতে কী? ভূত কি আর মানুষ নয়? অত দূরেই বা যেতে হবে কেন, এই তো হোথায় তেঁতুলতলার বটগাছে বকেশ্বর থাকে। শীতলামন্দিরের পিছনে থাকে কলসি-কানাই, শ্মশানের কালীমন্দিরের পিছনে থাকে দেড়েল-রঘু।
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, এদের সঙ্গেও তোমার ভাব আছে নাকি?
না। বশ্বের খুব ভিতু আর লাজুক। কলসি-কানাইকে নাকি কোন সাধুবাবা বলেছিল, তিন লক্ষ তিন হাজার তিনশো তিনটে সুচে সুতো পরাতে পারলেই নাকি সে যা চাইবে তাই পাবে। শুনেছি, কানাই নাকি মোট তিন হাজার সুচে সুতো পরাতে পেরেছিল। তারপরেই একদিন বউয়ের সঙ্গে ওই সুচে সুতো পরানো নিয়েই ঝগড়া লেগেছিল তার। ঝগড়া লাগারই কথা। কানাই যা রোজগার করত তার প্রায় সবটাই চলে যেত সুচ আর সুতো কিনতে। সংসারের সব কাজ ফেলে দিন-রাত শুধু সুচে সুতো পরালে কার না বউ রাগ করবে বলো! তা রেগে গিয়েই বউ বলেছিল, তোমার কি দড়ি-কলসি জোটে না! একথায় রেগে গিয়ে কানাই গলায় কলসি বেঁধে ঝিলে গিয়ে ডুব দিল। দিল তো দিলই। এখন সে বাকি সুচগুলোয় সুতো পরিয়ে যাচ্ছে। দম ফেলার ফুরসত নেই।
আর দেড়েল-রঘু? ও বাবা! সে মস্ত তান্ত্রিক। সাধন-ভজন নিয়ে থাকে, কারও দিকে ভুক্ষেপ নেই। তবে তারও শুনেছি একটা দুঃখ আছে। বেঁচে থাকতে তার দাড়ি মোট আড়াই হাত লম্বা হয়েছিল। তার খুব শখ ছিল চার হাত দাড়ির। দাড়ি মাটিতে ঘষটে যাবে, লোকে চেয়ে দেখবে, তবে না দাড়ির মহিমা। দাড়ির এমনই নেশা হয়েছিল যে, রঘু যখন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে কালীর দেখা পেল, আর মাকালী যখন বর দিতে চাইল, তখন রঘু চার হাত দাড়ির বর চেয়েছিল।
এঃ হেঃ, মাত্র চার হাত?
আপনি তো বলেই খালাস, মাত্র চার হাত! কিন্তু চার হাত দাড়ি নিয়ে বেঁটেখাটো নাটা মানুষ রঘু যে কী মুশকিলে পড়ল তা বলার নয়। দাড়ি মাটিতে হেঁচড়ে যায়, আর তাতে মাটি ঝটপাট হয় বটে, কিন্তু দাড়িতে উঠে আসে বিস্তর ময়লা, কাঠকুটো, ইঁদুরছানা, আরশোলা, ব্যাঙ, কাকড়াবিছে, কেন্নো, পিঁপড়ে। তা ছাড়া বে-খেয়ালে নিজের দাড়িতে পা বেঁধে কতবার আছাড় খেয়েছে তার হিসেব নেই। শেষে সেই দাড়ির জন্যেই তো প্রাণটাও গেল? ধানখেতের আলের রাস্তায় ওই দাড়িতে আটকেই একটা কেউটের বাচ্চা উঠে এসেছিল কিনা। তারপর আর দেখতে হল না।