উদ্ধববাবুর খবর শুনে নীলমাধব দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এল। তার বিশাল চেহারা। যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া। তবে চেহারাটা বড় থলথলে। বাজখাই গলায় সে হাঁক দিল, এখানে সোরগোল কিসের? কী হয়েছে? নীলমাধবের সঙ্গে দশ-বারোজন সেপাই। তারা লাঠি আনসাতে-আনসাতে ভিড় হঠিয়ে দিতে লাগল, হঠো, হঠো, বড়বাবুর আসবার সাস্তা করো।
নীলমাধব সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, কী হয়েছে উদ্ধববাবু?
উদ্ধববাবুর হাঁফটা একটু কমেছে। কাহিল মুখে বললেন, ওফ, খুব জোর প্রাণে বেঁচে গেছি বড়বাবু।
নীলমাধব হাঁক মেরে বলল, ওরে ষষ্ঠীচরণ, নোটবই বের কর, জবানবন্দি নে। হ্যাঁ, এবার বেশ গুছিয়ে বলুন তো, ঠিক কী ঘটেছে।
উদ্ধববাবু বেশ গুছিয়েই বললেন। ভূত হলেও হিজিবিজি যে অন্যান্য ভূতের মতো এলেবেলে ভূত নয়, সেটাও বুঝিয়ে ছাড়লেন।
নীলমাধব ভ্রূ কুঁচকে সব শুনল।
তারপর বলল, দেখুন, দিনের বেলায় আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। তবে রাতের বেলায় অন্য কথা। যাই হোক, এখন আমি আপনার গল্পে বিশ্বাস করছি না। আমার মনে হচ্ছে। আপনি একজন ডেনজারাস ক্রিমিনালের পাল্লায় পড়েছিলেন। সে মোটেই অদৃশ্য হয়ে যায়নি, গা ঢাকা দিয়েছে। হিজিবিজি তার আসল নাম হতে পারে না, ছদ্মনাম। এই ঘটনা থেকে মনে হচ্ছে, ময়নাগড় আর আগের মতো শান্তশিষ্ট জায়গাটি নেই। বিপদের কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে।
নীলমাধব তার সেপাইদের অকুস্থল মার্চ করার হুকুম দিল। তারপর বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে জলদগম্ভীর গলায় বলল, ভাইসব, বন্ধুগণ, প্রিয় দেশবাসী, মা, বোন, ভাইয়েরা, বয়োবৃদ্ধ, বয়োবৃদ্ধা, নাবালক, নাবালিকা, যুবক ও যুবতীবৃন্দ, কমরেডগণ, আমার সহযোদ্ধা এবং সহমর্মীগণ, সংগ্রামী শ্রমিক, কৃষক, মজদুর, আপামর নগর ও ভারতবাসী, প্রবাসী ও অনাবাসী, সবাইকেই জানাই আমার বিপ্লবী ও সংগ্রামী অভিনন্দন। আপনারা হয়তো জানেন না। ময়নাগড়ের শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ, এই স্বপ্নিল ছবির মতো গ্রামে, যেখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ, যেখানে গান গেয়ে বাউল নেচে বেড়ায়, যেখানে গান গেয়ে ধান কাটে চাষা, যেখানে পায়ের নীচে দূর্বা কোমল, মাথার উপর নীল আকাশ, যেখানে গাছে-গাছে থরে বিথরে ফুল ফল ধরে আছে, যেখানে গাঙের জলে ঝিলিমিলি ঢেউ খেলে যায়, মাঝির গলায় শোনা যায় ভাটিয়ালি গান, যেখানে খেতভরা ফসল, মরাই ভরা ধান, গোয়ালভরা গোরু, যেখানে মানুষের মুখে হাসি আর ধরে না, সেই ময়নাগড়ে বিপদের সংকেত এসে পৌঁছেছে। আপনারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুন, চারদিকে নজর রাখুন, সন্দেহভাজন কাউকে দেখতে পেলেই থানায় খবর দিন। এর জন্য আপনাদের হয়তো পুরস্কারও দেওয়া হবে।
নন্দগোপাল পশুপতিকে ঠেলা দিয়ে বললেন, এ কোন জায়গার কথা বলছে বলো তো!
ঠিক আঁচ করতে পারছি না। বিলেতেও বোধ হয় ময়নাগড় বলে কোনও জায়গা আছে।
না, বিলেত নয়। তবে সুইজারল্যান্ডে হলেও হতে পারে।
নীলমাধবের ভাষণ শেষ হওয়ার পর ফের বাজারের বিকিকিনি শুরু হল।
পাঁচুর মনটা ভালো নেই। এইসব গণ্ডগ্রাম থেকে অনেক দূরে হেলাবটতলার পাথরের উপর চুপচাপ বসে ভাবছিল সে। আজ হঠাৎ সে বুঝতে পারছে, পাঁচু হয়ে জন্মানোটাই তার ভুল হয়েছে। তাকে কেউ পোছে না, পাত্তা দেয় না, খাতির করে না, বসে তার সঙ্গে কেউ দুটো কথা অবধি কয় না। এমনকী তার নিজের বাড়িতেও তাকে কেউ যেন দেখেও দেখতে পায় না। বরাবর তাকে লোকে বোকা, গাধা ইত্যাদি বলে এসেছে। স্কুলের মাস্টারমশাই একবাক্যে বলতেন, তোর কিছু হবে না।
মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে না পারলে বেঁচে থেকে লাভ কী? কিন্তু এই মানুষের মতো মানুষ হওয়ার কথাতেই সে মুশকিলে পড়ে যায়। দুনিয়ায় তো হরেক কিসিমের মানুষ। কোন মানুষটার মতো মানুষ হলে ভালো হয় সেটাও তো বোঝা দরকার। তাই আজ বসে গম্ভীর হয়ে খুব ভাবছে পাঁচু।
কে একটা লোক এসে তার পাশটিতে বসে বলল, এ জায়গাটাই তো ময়নাগড়, নাকি হে?
পাঁচু আড়চোখে লক্ষ করল, লোকটা বেজায় ঢ্যাঙা, খুব ফরসা, গায়ে ঢোলা পোশাক আর পোঁটলাপুটলি আছে। ফিরিওলাই হবে বোধ হয়।
ছেলেটাকে পাঁচুর খারাপ লাগল না। তবে তার মনটা ভালো নেই বলে খুব উদাস গলায় বলল, এ হল ময়নাগড়।
ছেলেটা খুব মিষ্টি করে জিগ্যেস করল, তুমি কে ভাই?
পাঁচুর সঙ্গে এত মিষ্টি করে কেউ কখনও কথা বলে না। তাই তার ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সে একটু নড়েচড়ে বসে বলল, আমি হলুম পাঁচু, এ-গাঁয়ের সবচেয়ে বোকা লোক।
ছেলেটা চোখ কপালে তুলে বলে, আঁ! বলো কী? তুমি যে বোকা তা বুঝলে কী করে?
বোকা না হলে আমার আজ অবধি কিছু হল না কেন বলো তো! ক্লাস এইটে ফেন্টু মেরে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিতে হল। বাপ, মা, দাদা, দিদি, মাস্টারমশাইরা সবাই বলতেন, তোর কিছু হবে না। ভারী রাগ হল, বুঝলে! লেখাপড়া হল না বলে খারাপ লোক হওয়ার জন্য খুঁজে খুঁজে পলাশপুরের জঙ্গলে গিয়ে হাবু ডাকাতের সাঙাত হওয়ার চেষ্টা করলাম। দু-চারদিন তালিম দেওয়ার পর হাবু বলল, ওরে, তোর লাইন এটা নয়। যা বাপু, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা। কিছুদিন তক্কেতক্কে থেকে একদিন টকাইচোরকে গিয়ে ধরে পড়লুম। তা টকাই ফেলল না। যত্ন করে বিদ্যে শেখাতে লাগল। মাসখানেক পরে হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, না রে পাঁচু, এ জিনিস তোর হবে না। ভালো চোর হতে গেলে একটু মাথা চাই। রে। চালাক-চতুর-চটপটে না হলে চুরি-বিদ্যা কি শেখা যায়? তারপর এর, ওর, তার মতো হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু মেহনতই সার হল, যে পাঁচু সেই পাঁচুই রয়ে গেলাম। আজ সকাল থেকে নিজেকে বেজায় বোকা-বোকা লাগছে। মনে হচ্ছে বুদ্ধিটা আরও একধাপ নেমে গেছে।