আশ্চর্য তো!
এ আর আশ্চর্যের কী। বাজারের মাছওলা নিতাই একগাল হেসে বলল, উদ্ধববাবু, চোর তো বালিশটাই হাপিশ করে দেবে মোহরসুন্ধু! না না, ও আপনার বড্ড কাঁচা কাজ হয়েছে। সনাতন পাল বলল কী জানো? বলল, আহা বালিশের বাঁ-কোণে যে মস্ত একটা ছেঁড়া জায়গা রয়েছে উদ্ধববাবু, লক্ষ করেননি? চুরি যদি নাও যায়, ফুটো দিয়ে পড়েও তো যেতে পারে। তবেই বোঝো, ময়নাগড় কেমন জায়গা। এখানে লুকোছাপা ব্যাপারটাই নেই। সবাই সবাকার হাঁড়ির খবর জেনে যায়। আমার তো মনে হয় ময়নাগড়ের কুকুর, বেড়াল, পাখি-পক্ষী, পোকামাকড়, অবধি খবর ছড়িয়ে বেড়ায়।
হিজিবিজি ভাবিত হয়ে বলল, তা হলে তো মুশকিল। হল খুড়োমশাই!
তুমি বরং বৃন্দাবনঘাঁটি বা তালপুকুরে চেষ্টা করে দ্যাখো, এখানে সুবিধে হবে না।
আচ্ছা, তা হলে আসি খুড়োমশাই।
এসো গিয়ে। বলেই উদ্ধববাবু হাঁ। গাছতলায় দাঁড়ানো হিজিবিজি একটুও নড়ল না, চড়ল না, দাঁড়িয়ে থেকেই যেন হঠাৎ বাতাসে মিলিয়ে গেল। ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি চোখের পলকে ঘটে গেল যে, উদ্ধববাবু ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বেকুবের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ ওরে বাবা রে! ভূত! ভূত! ভূ… বলে চেঁচাতে চেঁচাতে প্রাণপণে দৌড় লাগালেন।
২. ময়নাগড় বাজারের লোকজন
ময়নাগড় বাজারের লোকজন ভারী অবাক হয়ে দেখল সকাল সোয়া সাতটায় উদ্ধববাবু হাঁফাতে-হাঁফাতে এসে বাজারে ঢুকছেন। কয়েকজন হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল। স্কুলের ইংরেজির মাস্টারমশাই তাড়াতাড়ি কবজির ঘড়িটা কানে তুলে দেখলেন, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে কিনা। জগদীশ হালুইকর তার জামাই গোপালকে ডেকে বলল, উদ্ধববাবুটা বোধহয় পাগলই হয়ে গেল রে! গায়ের বিখ্যাত দৌড়বীর পটল বলল, ওঃ, এই বয়সেও যা দৌড়টা দিলেন জেঠু, যৌবনে নিশ্চয়ই অলিম্পিকে গেলে মেডেল আনতেন। উদ্ধববাবু রাজু দাসের দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে লাগলেন, কথা কওয়ার মতো অবস্থা নেই। শুধু তার মধ্যেই বারকয়েক হিজিবিজি… হিজিবিজি…ভূ..ভূত.. বলে হাল ছেড়ে দিলেন। রাজু তাড়াতাড়ি টিউবঅয়েল থেকে জল এনে এই শীতে তাঁর মাথায় থাবড়াতে লাগল।
নয়নপুরের জমিদার সিদ্ধেশ্বরবাবু বললেন, উদ্ধব কিছু একটা বলবার চেষ্টা করছে মনে হয়। কী বলছে বলে তো?
রাজু বলল, উনি বলতে চাইছেন যে, উনি ভূত দেখেছেন। হিজিবিজি ভূত।
সিদ্ধেশ্বর চিন্তিত গলায় বললেন, আহা, সকালবেলাটায় ভূত কোথা থেকে আসবে। এ-সময়ে তাদেরও বিষয়কৰ্ম, প্রাতঃকৃত্যাদি থাকে।
নরহরি ঘোষ মাথা নেড়ে বলে, না মশাই, সায়েন্সে পরিষ্কার বলা আছে, ভূতেরা প্রাতঃকৃত্য, আচমন, স্নান, ভোজন এসব করে না। তবে সায়েন্সে বলা আছে, রোদ হচ্ছে ভূতের সবচেয়ে বড় শত্রু। গায়ে রোদ পড়লেই ভূত গায়েব। কাজেই বিজ্ঞানের নিয়মানুসারে উদ্ধববাবুর পক্ষে সকালবেলায় ভূত দেখা সম্ভব নয়।
সিদ্ধেশ্বর বললেন, আহা, ও তো নিজেই বলছে ভূত নয়, হিজিবিজি দেখেছে।
হিজিবিজি নয় সিদ্ধেশ্বরবাবু, উদ্ধববাবু বলতে চাইছেন, ইজি, বি ইজি। অর্থাৎ সব ঠিক আছে, তোমরা স্বাভাবিক হও।
পশুপতিবাবু মাথা নেড়ে বললেন, হল না হে, হল না। ইজি, বি ইজি মানে হল গিয়ে..দাঁড়াও বলছি, পেটে আসছে মুখে আসছে না..সে যাক গে, তবে রোদ উঠলে ভূত উবে যায় ও কথাটাও ঠিক নয়। শীতকালে জমাট নারকেল তেল। যেমন রোদে রাখলে গলে যায়, তেমনই রোদে ভূতও গলতে থাকে!
নরহরি ঘোষ খিঁচিয়ে উঠে বলল, বলি এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ফর্মুলা জানো?
পশুপতিবাবু জানেন না, তাই তিনি শুকনো মুখে পিছিয়ে দাঁড়ালেন।
নরহরি বুক চিতিয়ে বলল, তা হলে ফটফট করতে আসো কেন?
ব্যায়ামবীর গদাধর মাসল দেখানোর জন্য শীতেও হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে গম্ভীর গলায় বলল, উদ্বববাবু যে ভূত দেখেছেন তাতে সন্দেহ নেই। তেঁতুলতলার বেঁটে ভূতের কথা সবাই জানে। আর নরহরিবাবুকে বলি, রোদ লাগলে ভূত গায়েব, একথা যদি কেউ বলে থাকে, তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন
তো, দুই রদ্দায় তার ঘাড় ভেঙে দেব। রোদে যদি ভূত গায়েব হয়ে যায়, তা হলে শাস্ত্রে কি মিথ্যে কথা বলেছে যে, ঠিক দুকুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা!
একথায় বেশ জনসমর্থন পাওয়া গেল। নরহরি ঘোষ আর উচ্চবাচ্য করলেন না। কারণ, তিনি ব্যায়ামবীর গদাধরকে একটু সমঝে চলেন।
নিধুবাবু বলে উঠলেন, ও হো, তেঁতুলতলার বেঁটে ভূতের কথা বলছ তো! ও তো বকেশ্বর। তা বাপু, সত্যি কথা বললে বলতে হয়, বকেশ্বর ভারী নিরীহ, ভিতু আর লাজুক ভূত। জনসমক্ষে কখনও বেরোয় না। কেউ দেখে ফেললে লজ্জা পেয়ে, জিভ কেটে সরি বলে সরে যায়।
এক কেজি করলা কিনে গামছায় বেঁধে রামশরণ এসে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সব কথা শুনছিল। সে বলল, হাঁ হাঁ, উ বাত ঠিক আছে। বকাসুর পিরেতকে আমি ভি চিনি। উ তো উমদা ভূত আছে। আমি তো উসকো খইনি ভি খিলায়েছি।
এমন সময় চারদিকে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। দারোগা নীলমাধব রায় রোঁদে এসেছে। তাকে অবশ্য নিজের হাতে বাজার করতে হয় না। ব্যাপারিরাই তার বাড়িতে মাছ, মাংস, সবজি, দুধ, ঘি, ডিম সব পৌঁছে দিয়ে আসে। তবে কর্তব্যবশে সে বাজারে এসে সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে যায়।