ছোঁকরা মিষ্টি হেসে বলল, না ভাবছিলাম, আপনার সঙ্গে হয়তো আমার আগের জন্মে পরিচয় ছিল, তাই আমাকে আপনার এত চেনা-চেনা ঠেকছে।
উঁহু, তুমি আমাকে যত বোকা ঠাউরেছ, আমি তত বোকা নই হে। আমার স্মৃতিশক্তি অতি চমৎকার। এই। পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও সতেরোর ঘরের নামতা বলে যেতে পারি।
ওরে বাবা, সে তো খুবই শক্ত কাজ খুড়োমশাই!
তাই তো বলছি হে, আমাকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়।
ছেলেটা আমতা-আমতা করে বলল, তাই তো! বড্ড মুশকিলে ফেললেন দেখছি!
কেন হে বাপু, নাম-ধাম-পরিচয় বলে ফেললেই তো হয়।
নামটা বড় গোলমেলে। ভাবছি, আপনার যদি বিশ্বাস না হয়, পিতৃদত্ত নাম, ফেলেও দিতে পারি না।
আহা, নাম কি কেউ ফেলে? ও কি ফেলার জিনিস?
বাপ-পিতেমোর দেওয়া নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে হয়। নাও, বলে ফ্যালো, ফেললেই দেখবে ল্যাঠা চুকে যাবে।
আজ্ঞে না খুড়োমশাই, নতুন ল্যাঠাও উপস্থিত হতে পারে।
কেন হে বাপু, তোমার নামে কি হুলিয়া আছে?
বিচিত্র নয়। গুজব শুনেছি, অনেকে নাকি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ও বাবা! তা তুমি করেছটা কী?
সে বলতে গেলে মহাভারত। কাজ কী আপনার ওসব শুনে?
বলি চোর, ডাকাত বা খুনি নও তো?
ছেলেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সে হলেও তো ভাল ছিল খুড়োমশাই। আজকাল তো দেখতে পাই, চোর ডাকাত-খুনিদের বেজায় নামডাক আর বোলবালাও। তারাই সব মুরুব্বি-মাতব্বর কেষ্টবিষ্ট হয়ে বসে আছে।
যা বলেছ বাবা, একেবারে প্রাণের কথাটি। এই যে আমাদের ময়নাগড়ের মাতব্বর মহাদেব বিশ্বাস, দেখলে মনে হবে দেশের দরদে প্রাণ উথলে উঠছে। বললে পেত্যয় যাবে না, আঠারোখানা খুনের মামলা ছিল ওর নামে। ওই যে বিষ্ণু সাঁতরা, গাঁয়ে উন্নতির নামে সরকারি যে টাকা আসে, তা ফাঁক করে তেতলা বাড়ি করে ফেলল চোখের সামনে। আরও শুনবে? রাত ভোর হয়ে যাবে কিন্তু!
আজ্ঞে, তবে থাক।
তা তোমার অপরাধটা কী?
আজ্ঞে, বললে বিশ্বাস যাবেন না, আমার অপরাধ হল, আমি ম্যাজিক দেখাই।
ম্যাজিক দেখাও, বটে? তা সে তো খুব ভালো জিনিস হে! তাতে দোষের কী?
সেইটেই তো বুঝতে পারছি না খুড়োমশাই। তবে অনেকেই আমাকে ভালো চোখে দেখে না।
না হে বাপু, এ বড় হেঁয়ালি ঠেকছে। ম্যাজিকের মধ্যে আবার গন্ডগোেলটা কীসের? ম্যাজিক মানে তো হাতসাফাই আর একটু হিপনোটিজম। ও তো স্রেফ মজা ছাড়া কিছু নয়।
ওখানেই তো মুশকিল। আমার ম্যাজিকে অনেকে মজাটা খুঁজে পাচ্ছে না। তারা আমার গর্দান নেওয়ার জন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এটা তো খুব অন্যায় কথা হে!
আজ্ঞে, কলিযুগে ন্যায়টা আর দেখছেন কোথায় বলুন। সেও ঠিক কথা। কিন্তু ম্যাজিশিয়ানের গর্দান কেন চাওয়া হচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছি না। থাক গে, তোমার নামটা শুনি।
শুনে বিশ্বাস হবে তো আপনার?
খুব হবে, খুব হবে। আমার খুড়তুতো এক শ্যালক আছে, তার নাম পর্বত। আমার এক মাসতুতো দিদি আছে, তার নাম পেত্নি।
বাঃ, তবে তো আপনার অভ্যাস আছেই। আমার নাম হিজিবিজি।
উদ্ধববাবু একটু হাঁ করে চেয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ঠিক শুনেছি তত বাপু? আমার কানের কোনও দোষ হয়নি তো!
ভারী লাজুক মুখে ছেলেটা বলল, এতক্ষণ তো আপনার কান ঠিক মতোই কাজ করেছে, তাই না?
তা বটে।
দোষ নেবেন না খুড়োমশাই, আমি তো আগেই আপনাকে সাবধান করেছিলাম।
উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তা নামটাকে খারাপও বলা যাচ্ছে না, বেশ নতুন ধরনের নাম। তা বাপু হিজিবিজি, তুমি কি এই নামেই ম্যাজিক দেখাও? তোমার বাবা কি এই নামেই তোমাকে ডাকেন? যদি একদিন তোমার দেশজোড়া নাম হয় তখনও কি এই নামই বহাল থাকবে? উপায় কী বলুন। এই নামেই যে সবাই আমাকে চেনে। তা বাপু হিজিবিজি, তোমার বাবা এই মোক্ষম নামটা পেলেন কোথা থেকে?
শুনলে হাসবেন খুড়োমশাই, ছেলেবেলায় খুব দুষ্টু ছিলাম তো। সর্বদাই অকাজ-কুকাজ করে বেড়াতুম। বাবা আমাকে দেখিয়ে লোককে বলত, হি ইজ বিজি। সেই থেকেই লোকে হিজিবিজি বলে ডাকতে শুরু করে। শেষে এই নামটাই আমার সঙ্গে সেঁটে গেল।
উদ্ধববাবু ভারী খুশি হয়ে বললেন, এইবার বুঝলুম, বাঃ এই তো হিজিবিজি একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল। তা বাবা হিজিবিজি, তুমি কি ম্যাজিক দেখানোর মতলবেই ময়নাগড়ে এসে জুটেছ?
মাথা নেড়ে একটু হেসে হিজিবিজি বলে, না খুড়োমশাই, ম্যাজিক আমার মাথায় উঠেছে। আমি এসেছি বিপদে পড়ে। গত সাতদিন ধরে এক জায়গায় দুরাত্তির থাকতে পারিনি।
কেন বাপু, কেন?
চারদিকে আমার খোঁজ হচ্ছে যে!
কারা খুঁজছে তোমাকে? তারা কি খারাপ লোক?
সবাইকে খারাপ বলি কী করে বলুন! ধরুণ পুলিশ, মিলিটারি, ইন্টারপোল, আন্তর্জাতিক গুন্ডা কে না খুঁজছে আমাকে। সবাই তো আর খারাপ লোক নয়।
তা হলে গা-ঢাকা দিতে এসেছ নাকি? সে গুড়ে বালি। এখানে কারও পেটের কথা গোপন থাকে না। মাঝরাত্তিরে হয়তো তোমার কান কটকট করেছিল, সকালে উঠে দেখবে সারা তল্লাটে তাই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তোমাকে কী বলব বাবা, মা মরার সময় দশটা মোহর তার বাক্স থেকে বের করে আমাকে দিয়ে বলেছিল, সাবধানে লুকিয়ে রাখিস। তা আমি নিশুতি রাতে সেই মোহর অন্ধকারে বসে বালিশের সেলাই খুলে তার মধ্যে ঢুকিয়ে ফের সেলাই করে দিই। আগাগোড়া অন্ধকারে কাজ করতে হয়েছিল, তাতে বারদশেক ছুঁচের খোঁচা খেতে হয়েছিল হাতে। এত সাবধান হওয়া সত্ত্বেও পরদিন সাতকীবাবুর সঙ্গে দেখা হতেই গম্ভীর মুখে বললেন, মাসিমার দেওয়া মোহরগুলো বালিশে ভরে রাখা কি নিরাপদ হল মশাই?