ছোঁকরা চোখ নাক কুঁচকে বলল, এবারের অনুমানটাও বড় কাছাকাছি এসে গেছে মশাই। আপনার দেখার চোখ আছে বটে! দিব্যদৃষ্টি কি একেই বলে!
হেঁ-হেঁ, কী যে বলো শিবু। ওইটেই আমার দোষও বটে, গুণও বটে। মুখ দেখে পেটের কথা ধরে ফেলতে পারি বলেই অনেকে যেমন আমার সুখ্যাতি করে। তেমনই আবার কারও কারও আঁতেও লাগে। এই তো সেদিন রামগোপাল বটতলায় মুখোনা শুকনো করে বসে ভাবছিল। আমি সটান গিয়ে তাকে বললুম, কী রে রেমো, তোর বউয়ের সঙ্গে আজ ঝগড়া হয়েছে তো! রেমো তো অবাক। বলল, কী করে বুঝলেন দাদা! দিন, পায়ের ধুলো দিন। তা হলে সব ঠিকঠাকই বলেছি তো শিবু? ভুল করিনি তো?
ছোঁকরা সবেগে মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে না, ভুল হওয়ার জো-ই নেই। শুনতে-শুনতে এখন তো নিজেকে আমার শিবু বলেই মনে হচ্ছে। নিজের গা থেকে আমি একটা শিবু শিবু গন্ধও পাচ্ছি।
উদ্ধববাবু হাঁ করে একটু চেয়ে থেকে বললেন, তা হলে কি তুমি বলতে চাও যে, তুমি শিবু নও? আপত্তি থাকলে আমি চাপাচাপি করব না। ঘড়িচোরের বদনাম ঘাড়ে নিয়ে শিবু হতে কারই বা ইচ্ছে থাকে। বলি, পরান মণ্ডলের মেজো ছেলে প্রাণকৃষ্ণ কি না জিগ্যেস করলেও তুমি হয়তো বলে বসবে, প্রাণকৃষ্ণকেও তুমি চেনো না। তা প্রাণকৃষ্ণ তো আর ঘড়ি চুরি করেনি। দোষের মধ্যে তার একটু থিয়েটার করার শখ ছিল। চেহারাখানাও বেশ নাদুসনুদুস। শেষে মুম্বই গিয়ে জুটেছিল সিনেমায় নামবে বলে। ইদিকে আমরা গাঁসুন্ধু লোক সিনেমার পরদায় তার দেখা পাব বলে আশপাশের শহরে গিয়ে রাজ্যের হিন্দি সিনেমা দেখতে লাগলাম। কোনওটাতেই প্রাণকৃষ্ণ নেই। মুরগিহাটার কুশচন্দ্র অবশ্য বলেছিল, কোনও একটা সিনেমায় নাকি নারদের রোলে এক মিনিটের জন্য তাকে দেখিয়েছে। তবে নারদের যা বিচ্ছিরি দাড়িগোঁফ, তাতে কুশচন্দ্রের ভুলও হতে পারে। ফরসাগঞ্জের ফটিক খুব জোর দিয়ে বলেছিল, সে নাকি প্রাণকৃষ্ণকে পিয়াস লাগি ছবিতে একটা চাকরের পার্ট করতে দেখেছে। সিনেমায় প্রাণকৃষ্ণের নাম হয়েছে প্রাণকুমার। কিন্তু ফটিক দিনেদুপুরে মিথ্যে কথা বলে। তা সে যাই হোক, প্রাণকৃষ্ণের কোনও খবর সেই থেকে আর পাওয়া যায়নি। তোমাকে দেখে আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে, আমাদের সেই প্রাণকৃষ্ণই ফিরে এল কি না! কী হে বাপু, শুনে যে মুখোনা একেবারে শুকিয়ে গেল! ওরে বাপু, ঘাবড়ানোর কী আছে? সত্যি কথাটা যদি বলেই ফ্যালো, তা হলে তো আর আমি লোককে বলে বেড়াব না। আমরাও তো জানি ফিল্মস্টারদের কত হ্যাপা সামলাতে হয়। অটোগ্রাফ দাও রে, সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে ফোটো তোলো রে, এ পেন্নাম করে তো ও ছুঁয়ে দ্যাখে, রক্তমাংসের মানুষ কি না। তা বাপু, তোমার কোনও ভয় নেই, তুমি যে ফিল্মস্টার তা কাকপক্ষীতেও জানবে না। কথা দিচ্ছি। আমাদের সেই প্রাণকৃষ্ণ এত বড় কেউকেটা হয়েছে, এ তো তল্লাটের মস্ত গৌরব!
ছেলেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ধরে যখন ফেলেছেনই, তখন লুকিয়ে আর কী লাভ খুডোমশাই। আপনার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার এলেম আমার নেই। তবে কিনা আমাকে ফিল্মস্টার বলাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। প্রাণকৃষ্ণ বলুন, আপনি গুরুজন, মাথা পেতে মেনে নেব। কিন্তু ফিল্মস্টার বললে আসল ফিল্মস্টাররা ভারী অপমান বোধ করবেন!
বটে! তা হলে কি তুমি ফিল্মস্টার হতে পারোনি হে প্রাণকৃষ্ণ?
আজ্ঞে না।
কুলাঙ্গার! কুলাঙ্গার! আমরা হাপিত্যেশ করে এতকাল বসে রইলাম তোমাকে সিনেমায় দেখব বলে, তা সেটা পেরে উঠলে না? ছিঃ ছিঃ, লোকের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে?
আজ্ঞে, সেই জন্যই তো আড়ালে আবডালে মুখ লুকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
অপদার্থ আর কাকে বলে! ওরে আহাম্মক, ফিল্মস্টার হতে কী এমন হাতিঘোড়া লাগে বল তো! ক্যামেরার সামনে একটু নাচগান, একটু ফাঁইট আর ডায়লগ হাঁকড়ে যাওয়া। এও পেরে উঠলে না?
ছেলেটা ভারী কাচুমাচু হয়ে বলে, সবার কি সব হয় খুডোমশাই? ফিল্মস্টার হতে পারিনি, প্রাণকৃষ্ণও হতে পারব কি না জানি না। প্রাণকৃষ্ণ হতে চাইলেই তো হবে না, প্রাণকৃষ্ণ এবং তার বাবা-মা, তস্য আত্মীস্বজন ও বন্ধুবান্ধবাদি নানারকম আপত্তি তুলতেই পারে। থানা-পুলিশ হওয়াও সম্ভব। ভেবে দেখুন, এত সব ফ্যাকড়ায় আপনিও জড়িয়ে পড়তে চান কি না।
উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, প্রাণকৃষ্ণ না হয় নাই হলে, তা বলে তুমি লোকটা আসলে কে, তাও তো জানা দরকার হে! গায়ে একটা উটকো লোক হঠাৎ
উদয় হলে চারদিকে একটা কানাকানি, ফিসফাস শুরু হবে না? চাই কী, দাঙ্গাহাঙ্গামাও বেধে যেতে পারে। এই তো বছরতিনেক আগে এক মস্ত জটাজুটধারী সাধু এসে থানা গেড়েছিল বটতলায়, সঙ্গে গুটিদুই চেলা। পরে শোনা গেল, সে নাকি স্পাই। দিনকাল তো ভাল নয় হে। তাই বলছি, ঝেড়ে কেশে ফ্যালো। তোমাকে আমার বড় চেনা-চেনা ঠেকছে কেন কে জানে!
জন্মান্তর মানেন খুড়োমশাই?
কেন বাপু, জন্মান্তর মানব না কেন? আমাদের রামহরি গুণ মস্ত তান্ত্রিক। ভৃগুর গণনায় একেবারে সিদ্ধবাক। কে আগের জন্মে কী ছিল, তা গড়গড় করে বলে দেয়। তোমাকে চুপিচুপি বলছি, কাউকে বোলো না, আমাদের মন্মথবাবু নাকি আগের জন্মে কুমির ছিলেন। আমার কেমন যেন আগে থাকতেই তা মনে হত। আমার সেজো ছেলে পন্টুকে যখন ক্লাস এইটে তিনবার ফেলে করিয়ে দিয়েছিলেন, তখনই আমার মন বলছিল, উনি কুমির না হয়ে যান না। কুমির নাগালে পেলে তোমাকে কিছুতেই ডাঙায় উঠতে দেবে না, ঠ্যাং কামড়ে হিড়হিড় করে জলে নামাবেই কি নামাবে। দিল আমার পন্টুকে ডাঙায় উঠতে? এই যে পশুপতিবাবুর কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা হাওলাত নিয়েছিলাম, চণ্ডীমণ্ডপে মাতব্বরদের সামনে কী অপমানটাই করলেন আমাকে। তা তিনি আগের জন্মে কী ছিলেন, জানো? চুম্বক লোহা, চুম্বক লোহা আশপাশের সব জিনিস টেনে রাখে, উনিও তাই, ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। তা বাপু, জন্মান্তরের কথাটা উঠছে কেন?