বাবাজির কি অনুতাপও হচ্ছে নাকি?
হচ্ছে, হচ্ছে। অনুতাপ তুষানল, দগ্ধে-দন্ধে মারে। মারধর করো, সইবে। কিন্তু অনুতাপ বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস। ভিতরটা আংরা করে দেয়।
ওর নাম কি হিজিবিজি?
তা জানি না। মাঝে-মাঝে শুধু বলত, হিজিবিজি, হিজিবিজি।
তারপর কী হল বলুন। বলছি, বাবা, বলছি। আজ সকালবেলায় মদন যেন কোথায় বেরোল। একা বসে সাধনভজনের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আজ বড় গা ছমছম করছিল। কোথা থেকে একটা বোঁটকা গন্ধ আসছিল। বাইরে মাঝে-মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত হাওয়ার শব্দ হচ্ছে। শুকনো পাতার উপর পা ফেলে কারা যেন হাঁটছে। বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে কত দিন আর কত রাত কাটিয়েছি, কিন্তু আজকের মতো এরকম অস্বস্তি কখনও হয়নি। মনে হচ্ছিল, আজ একটা কিছু ঘটবে। আমাকে পাষণ্ডই ভাবো কিংবা যাই ভাবো বাপু, সাধু হওয়ার জন্যই কিন্তু সংসার ছেড়েছিলুম। শেষ অবধি সাধু হতে পারিনি, ভেক ধরে ঘুরে বেড়াই। তবু লোকটা আমি তেমন খারাপ ছিলুম না হে। একটু মনুষ্যত্ব যেন এখনও আছে। তাই আজ সন্ধেবেলায় ভাবলুম, হিজিবিজিকে এরকমভাবে আটকে রেখে বড় পাপ হচ্ছে। কিন্তু ছেড়ে দিলে যদি বাঘে খায়, কি বুনো কুকুরে ধরে, সেই ভয়ে ছাড়তেও দনোমনো হচ্ছিল। তারপর ভাবলুম, ওই বন্দিদশা থেকে তো আগে মুক্ত করি, ছাড়ার কথা পরে ভাবা যাবে। মনটা স্থির করে বাক্সের ডালা খুলে দিয়ে বললুম, বাবা হিজিবিজি, দোষঘাট ও না, তোমার প্রতি বড় অত্যাচার-অবিচার করেছি, আজ ক্ষমা করে দাও।
তারপর? হিজিবিজি কী বুঝল, কে জানে! তবে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে গুটগুট করে বেরিয়ে গেল।
সত্যি বলছেন তো?
সত্যি বলছি বাবা, মারো, কাটো যা খুশি করো, মিথ্যে বলব না। হিজিবিজি চলে যাওয়ার পর মাথাটা একটু থিতু হল। ভালো করলাম না মন্দ করলাম কে জানে। মদন হয়তো এসে আমাকে খুনই করবে। তবু যা ভালো বুঝেছি, করেছি।
তারপর কী হল?
জটাবাবা শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে চেটে মিয়ানো গলায় বললে, খুব দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল। এই জঙ্গলে মাঝে-মাঝে বাঘ ঘুরে বেড়ায়, বুনো কুকুরও আছে। তাদের পাল্লায় পড়লে হিজিবিজি চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে। এই সব ভেবে সাধনভজনে মন বসাতে পারছিলাম না। হঠাৎ শুনি, বাইরে থেকে একটা অদ্ভুত সুন্দর শিসের শব্দ হচ্ছে। সে এমনই সুর, প্রাণ যেন আনচান করে ওঠে। মনে হয় যেন, স্বর্গের দেবতাদেরই বোধহয় আগমন ঘটেছে। কী বলব বাবারা, আমার চারদিকে বাতাসটাও যেন নেচে উঠেছিল সেই সুরে। পাগলের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু দরজায় থমকে দাঁড়াতে হল, যা দৃশ্য দেখলাম, জন্মেও ভুলব না।
কী দেখলেন বাবাজি?
জটাবাবার চোখ দুটো যেন হঠাৎ স্বপ্নাতুর হয়ে গেল। উধ্বদৃষ্টিতে খানিক চেয়ে থাকলেন। চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়ছে। স্বলিত কণ্ঠে বললেন, যারা জন্মের তপস্যাঁতেও ও জিনিস দেখিনি, দেখলাম, হিজিবিজি দুলে-দুলে হাঁটছে। আর তার পিছনে চলেছে রাজ্যের জন্তু-জানোয়ার। দুটো হরিণ, একটা বাঘ, কয়েকটা খরগোশ, আরও কী কী যেন! পোষমানা জীবজন্তুর মতো হিজিবিজির সঙ্গে চলেছে, একটু পরে তারা অন্ধকারে মিলয়ে গেল।
তারপর কী হল বাবাজি?
ওই কাণ্ড দেখে নিজের উপর বড় ঘেন্না হল বাবা।
সাধনভজন করি, কিন্তু কই, বুনো জন্তুরা তো কখনও পোষ মানেনি আমার! তবে কি ওই হিজিবিজি আসলে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কেউ? যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তো আমার বড় অধর্ম হয়েছে! আত্মগ্লানি আর অনুশোচনায় বসে-বসে তাই চোখের জল ফেলছিলাম। এমন সময় একটা মাঝবয়সি লোক কোথা থেকে এসে উদয় হল। পাকানো চেহারা, চোখ যেন ধকধক করে জ্বলছে। ঘরে ঢুকেই হাঁক মেরে বলল, কই, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস আমার হিজিবিজিকে? আমি থতমত খেয়ে বললুম, সে নেই। চলে গিয়েছে। লোকটা এ কথায় ভারী অবাক হয়ে বলল, সর্বনাশ! কোথায় গেছে? মাথা নেড়ে বললুম, জানি না। তারপর লোকটা হঠাৎ তেড়ে এসে আমার উপর চড়াও হল। কী মার! কী মার! প্রথম কয়েকটা ঘুসো খেয়েও জ্ঞান ছিল। তারপর কিছু মনে নেই।
লোকটা কে?
তা কী করে বলব বাবা! হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা জামা আর চাঁদরের মতো কিছু ছিল। গোঁফ আছে। বাবুগোছের লোক। নয়, গতরে খেটে খাওয়া লোক। রাগের চোটে যেরকম ফুঁসছিল, তাতে আমাকে যে খুন করেনি সেটাই ভাগ্যি।
এবার যে আপনাকে গা তুলতে হবে বাবাজি। চলুন।
কোথায় যেতে হবে বাপু?
তা জানি না। তবে হিজিবিজিকে খুঁজে বের না করলেই নয়। আপনার কথা শুনে যা বুঝেছি, তাতে মনে হয়, আপনার স্যাঙাত মদনা খুব ভালো লোক নয়। হিজিবিজি যদি ফের তার খপ্পরে পড়ে, তা হলে তার কপালে দুঃখ আছে।
জটাবাবা মাথা নেড়ে বললেন, তা বটে। শুনেছি হিজিবিজিকে বিক্রি করলে সে নাকি মোটা টাকা পাবে। কয়েক লাখ।
বাবাজি, অভয় দেন তো একটা কথা কই।
বলো বাপু।
আপনাদের দুজনের কাছেই বন্দুক-পিস্তল আছে। কেন বলুন তো? বন্দুক-পিস্তলও কি সাধনভজনে লাগে?
জটাবাবার মুখোনা হঠাৎ যেন ফ্যাকাসে মেরে গেল। আমতা-আমতা করে বললেন, সে আমার জিনিস নয় বাপু। মদনার জিনিস।
আপনি বন্দুক চালাতে পারেন?
মদনাই একটুআধটু শিখিয়েছে। তবে বাপু সত্যি কথাই বলি, ওসব আমি পছন্দ করি না। আপনি কি বলতে চান, আপনি খুব ভাল মানুষ! যত দোষ ওই মদনার? যাকগে, আপনাকে আর জ্বালাতন করতে চাই না। উঠুন। নবা কম্বলটম্বর সরিয়ে বন্দুকটন্দুক যা পাস বের কর তো। থানায় জমা করতে হবে।
৭. শ্যমাচরণকে কোথাও খুঁজে দেখতে
শ্যমাচরণকে কোথাও খুঁজে দেখতে বাকি রাখল না শিবেন। নিবুনিবু টর্চের আলোয় সাধ্যমতো আগাছা জর্জরিত রাজবাড়ির বাগানের ঝোঁপ-জঙ্গলেও খুঁজল। খুঁজতে খুঁজতে পরিশ্রমে গা গরম হয়ে ঘামতে লাগল সে। ভজহরিকে শিবেন বড়ই ভয় পায়। ভজহরির গায়ের জোর বেশি, বুদ্ধির জোর বেশি, মনের জোর বেশি। কোনওদিকেই সে ভজহরির সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি। শুধু লেখাপড়ায় ভজহরি তার চেয়ে একটু পিছিয়ে। আর ভজহরি সেই জন্যই শিবেনকে এত হিংসে করে। নইলে খুঁজে-খুঁজে এই অজ পাড়াগাঁয়ে শিবেনের খোঁজে এসে হাজির হত না। তবে ভজহরি যখন এসেছে, তখন শিবেনকে বিপাকে ফেলবেই। ভয়ে শিবেনের বুক ধুকপুক করছে। ভজহরির অবাধ্য হওয়ার সাধ্যই নেই তার। ভজহরির আদেশ না মানলে কোনদিক দিয়ে কোন বিপদ আসবে, তা কেউ জানে না।