আজও উদ্ধববাবু সাতসকালেই বেরিয়েছেন বটে। সাড়েচারটেয় বেরিয়ে এই সকাল ছটা নাগাদ বাড়ি থেকে মোট একশো গজ আসতে পেরেছেন। সাতজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়েছে, পরেশবাবুর বাড়িতে চা আর বিস্কুট খেয়েছেন। নরেশবাবুর বাড়িতে চারখানা নারকেলের নাড়ু আর জল, খগেনবাবুর বাড়িতে মাখন-টোস্ট দিয়ে এক কাপ কফি আর রমেশবাবুর বাড়িতে দু-গেলাস খেজুরের রস। আরও হবে, পথ এখনও মেলা বাকি।
সাতুবাবুর লাল গাইটার কাল পেট খারাপ করেছিল। তারও একটু খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন উদ্ধববাবু। দেখলেন, গাই ভালো আছে। সাতুবাবু সেই গোরুর এক গেলাস দুধও খাওয়ালেন তাঁকে। দুধ খেয়ে তেঁতুলতলার পথ ধরে বড় সড়কের দিকে এগোচ্ছিলেন উদ্ধববাবু। সকালবেলায় আজ খাওয়াদাওয়াটা বেশ হয়েছে। মনটা খুশি খুশি লাগছে। তেঁতুলতলার পথটা ভারী নির্জন আর জংলা, রাস্তা বলতে একটা সরু মেটে পথ, দু-ধারে আগাছা আর কাটাঝোঁপের জঙ্গল। দুটো কয়েতবেলের গাছ আছে বা ধারটায়। কদিন আগেও দেখেছেন প্রচুর কচি কয়েতবেল ফলেছে। এখন একটাও নেই। গাঁয়ের পাজি ছেলেগুলো ফলপাকুড় মোটে পাকতেই দেয় না। ধীরেসুস্থে চারদিক দেখতে-দেখতে, আর সকালবেলার মিঠে রাঙা রোদ আর চারদিককার দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে করতে উদ্ধববাবু সড়কের দিকে মোড় ঘুরেই দেখতে পেলেন, বটতলার ছায়ায় একটা ভারী ঢ্যাঙা লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে একটা ঢোলা পাতলুন গোছের জিনিস, গায়ের কামিজটাও বেজায় ঢলঢলে। দুটোর রংই নীল। মাথায় একটা গোলমতো টুপিও আছে, তবে গায়ে গরম জামা নেই। উদ্ধববাবু লোকটাকে চিনতে পারলেন না। এরকম ঢ্যাঙা কোনও লোকের সঙ্গে তার পরিচয় নেই।
তবে লোকটাকে দেখে খুশিই হলেন উদ্ধববাবু। নতুন লোকের সঙ্গে কথা কয়ে আরাম আছে। কত কী জানা যায়।
মুখোমুখি হতেই দেখতে পেলেন, লোকটা বেশ ফরসা, মুখ-চোখ বেশ ভালো, চিনেদের মতো ঝোলা গোঁফ আছে। আর ডান বগলে একটা বড়সড়ো পোঁটলা আর বাঁ-কাঁধ থেকে একটা ছোট ঢোলের মতো জিনিস দড়িতে ঝুলছে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়।
উদ্ধববাবু একগাল হেসে বললেন, এ গাঁয়ে নতুন বুঝি?
ছোঁকরা একটু ফচকে হাসি হেসে বলল, তা একরকম নতুনই বলতে পারেন। তবে এককালে আমার ময়নাগড়ে যাতায়াত ছিল।
বটে! তা হলে তো তুমি এ গাঁয়ের পুরোনোলোকই বটে। বাবার নাম কী বলো তো? কোন পাড়ায় বাড়ি? কাঁদের ছেলে তুমি?
ছোঁকরা তেমনই ফচকে হাসি হেসে বলল, আন্দাজ করুন তো!
উদ্ধববাবু বললেন, দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। মুখটা বড্ড চেনা-চেনা ঠেকছে! আচ্ছা, তুমি মদন পোদ্দারের ভাগ্নে নও তো? এইটুকুন দেখেছি। ছেলেবেলায় বড্ড বাঁদর ছিলে বাবা। গাছ বাওয়া, ফল-পাকুড় চুরি করা, ঢিল মারা, মারপিট করা, পড়াশুনোয় ফাঁকি, কোন গুণটা না ছিল তোমার! তবে আমি কিন্তু বরাবর মদনকে বলে এসেছি, ওরে মদন, যারা ছেলেবেলায় দুষ্ট থাকে, তারা বড় হয়ে কেষ্টবিষ্টু হয়ে দাঁড়ায়। দেখিস, এ ছেলে এলেবেলে নয়, জজ-ব্যারিস্টার না হয় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবেই। তা বাপু, এখন কী করাটরা হয়?
ছোঁকরা ভারী সপ্রসংশ চোখে উদ্ধববাবুকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল, আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই! আমার সম্পর্কে আপনার অনুমান তো প্রায় মিলেই গেছে দেখছি! বাঃ!
উদ্ধববাবু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, মিলবে না! লোকে তো পঞ্চমুখে বলে, হা উদ্ধবের চোখ আছে বটে, একবার যা দেখে তা বিশ-পঁচিশ বছরেও ভুল হওয়ার জো নেই।
তাই দেখছি।
তা মদনের বাড়িতে উঠেছ তো!
আজ্ঞে না।
কেন বলোত! মামার সঙ্গে কি বনিবনা হচ্ছে না? নাকি মামি হুড়ো দিচ্ছে! মদনের বউটা অবশ্য একটু কুঁদুলে আছে।
মামার বাড়িতে যে উঠিনি তার কারণ আপনি ঠিকই ধরেছেন। বনিবনা নেই। আর মামির ব্যাপারেও বোধহয় আপনি খুব একটা ভুল বলেননি। তবে তৃতীয় আর-একটা কারণ আছে।
উদ্ভববাবু সাগ্রহে গলাটা খাটো করে বললেন, কী কারণ বলো তো বাপু। ভয় নেই, আমি পাঁচকান করব না।
কথা দিলেন তো?
মা কালীর দিব্যি।
তা হলে চুপিচুপি বলি। কারণটা হল, মদন তপাদার আমার মামা নন।
আঁ! তবে যে মদন তোমাকে ভাগ্নে বলে পরিচয় দিত! সেটা কি তবে মিথ্যে কথা? কাজটা তো মোটেই ঠিক করেনি মদন!
ছোঁকরা ফের একটা ফিচকে হাসি হেসে বলল, মদন তপাদারকে মোটেই বিশ্বাস করবেন না মশাই। যাকে-তাকে ভাগ্নে বলে চালিয়ে দেন।
উদ্ধববাবু সাগ্রহে বললেন, আর কাকে ভাগ্নে বলে চালিয়েছে বলো তো!
ছেলেটা ভালমানুষের মতো বলল, তা অবশ্য আমি জানি না। কারণ, আমি মদন তপাদারকে চিনি না, কস্মিনকালেও দেখিনি। উদ্ধববাবু চোখ বড়-বড় করে বললেন, দ্যাখোনি! অ, তা হলে তুমি মদনের সেই ভাগ্নে নও বোধহয়।
আজ্ঞে না। তবে আপনার অনুমান খুব কাছাকাছি গেছে। মদন তপাদার না হলেও আমি কারও-না কারও ভাগ্নে তো বটে।
তা, সেটা আগে বলতে হয়। তবে তোমার মুখোনা বড় চেনা-চেনা ঠেকছে হে। কোথায় যেন দেখেছি! আচ্ছা, তুমি নিমাইচাঁদের সেই নিরুদ্দেশ নাতি শিবাদ নও তো! আহা, শিবচাঁদ বড় ভালো ছেলে ছিল। সাত-পাঁচে নেই, সাত চড়ে রা কাড়ে না, সাত-সতেরোয় থাকে না, সাতকাহন গল্প ফেঁদে বসে না, সপ্তগ্রামে গলা তুলে চেঁচায় না, আর তাকেই কিনা সাতঘাটের জল খাইয়ে ছাড়লে সাতকড়ি সরখেল। কী না সরখেলের বাবাকেলে পকেটঘড়িটা চুরি গেছে। ওরে বাবা, ঘড়ি কার না চুরি যায়! দুনিয়ায় কি ঘড়িচোরের অভাব আছে! তা সাতকড়ির সন্দেহ গিয়ে পড়ল শিবচাঁদের উপর। কেন, না শিবচন্দ্র নাকি দুপুরে গোবর কুড়োতে এসে সাতকড়িকে টাইম জিগ্যেস করেছিল। সুতরাং সাতকড়ির মনে হয়েছে, ও ঘড়ি শিবু ছাড়া আর কেউ সরায়নি। থানা-পুলিশ করে শিবুকে কী হেনস্থাটাই করল সাতকড়ি। সেই দুঃখেই ছেলেটা বিবাগী হয়ে গিয়েছিল। যাক বাবা, এতদিন পর যে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছ, দেখেই ভারী আনন্দ হচ্ছে হে শিবু। তা আর কোনও চুরির মামলায় ফেঁসে যাওনি তো বাবা! দাদুর সঙ্গে দেখা করেছ তো! সেই নাক, সেই মুখ, সেই চোখ, ঠিক আগের মতোই আছ বাবা শিবু। তবে সেই শিবু ছিল বেঁটে, তুমি একটু লম্বা। শিবুর গায়ের রং ছিল কালো, তুমি অবশ্য ফরসাই। শিবুর চুল ছিল সটান, তোমার টুপির ধার দিয়ে যা দেখছি তাতে চুল কোঁকড়া বলেই মনে হচ্ছে। তা হোক, তা হোক, অত ধরতে নেই। দু-চারটে জিনিস না মিললে তুমিই যে আমাদের শিবু তাতে সন্দেহের অবকাশই নেই।