পাঁচ গম্ভীর হয়ে বলল, আমার তো এদের তেমন বোকা বলে মনেই হচ্ছে না।
খুব ঠিক কথা। আমারও মনে হচ্ছে না। যারা নিজেদের বোকা বলে বুঝতে পারে, তারা আবার বোকা কীসের? আসল বোকা হল সে-ই, যে নিজে বুঝতেই পারে না যে, সে বোকা।
পাঁচু করুণ মুখ করে বলল, তা হলে আমার কী হবে হিজিবিজিদাদা? আমি যে বোকা, সেটা যে আমিও বুঝতে পারি!
সেই জন্যই তো তোমাকে বলছিলাম, সত্যিকারের বোকা লোক খুঁজে বের করা খুব কঠিন। ভগবান বোকা লোক মোটেই সাপ্লাই দিচ্ছেন না। তাই তো বুড়োশিবতলার হাট থেকে পালিয়ে বাঁচতে হল। তারপর থেকে গা-ঢাকা দিয়েই থাকতে হয়েছে। বোকা লোকরা কোমর বেঁধে খুঁজছে কিনা আমাকে!
পাঁচু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বোকা হয়েও সুখ নেই। দেখছি।
তোমার দুঃখেরও কিছু নেই। তোমার মতো চালাকচতুর, চটপটে, চারচোখা ছেলের কাজের অভাব হবে না। তবে আমি এখন বোকা ছেড়ে মোটা লোক খুঁজে বেড়াচ্ছি।
সে আবার কীরকম।
এই ধরো, বেশ গোলগাল মোটাসোটা চেহারার লোক। বেঁটে মতো হলে খুবই ভালো হয়। যদি সন্ধান দিতে পার, তবে হাতে-হাতে পঞ্চাশ টাকা নগদ পাবে।
ঠোঁট উলটে পাঁচু বলে, এ গাঁয়ে মোটা লোকের অভাব কী? গদাধর মোটা, ভজহরিবাবু মোটা, বিষ্ণুবাবু মোটা…
আহা, ওদের কথা হচ্ছে না। যেমন-তেমন মোটা হলে চলবে না। মোটা-মোটা বেঁটে, বিটকেলোনা হলে ভালো হয়। তা সন্ধানে আছে নাকি?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাঁচু বলল, সন্ধান তো ছিল। কিন্তু সেই লোকটা যে মজা পুকুরের কাদায় ডুবে গেছে!
আঁ! বলে একটা বুকফাটা চিৎকার দিয়ে উঠল হিজিবিজি। তারপর পাঁচুর কাধ ধরে একটা রাম-ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সত্যি বলছ? কোথায় সেই মজা পুকুর?
পাঁচু একটু ঘাবড়ে গিয়ে দু-পা পিছিয়ে বলল, সত্যি কথাই বলছি। নিজের চোখেই দেখা বলতে পার। একটু আগেই বিটকেল মানুষটা সটান গিয়ে পুকুরে ডুবেছে…
তার হাতে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে হিজিবিজি বলল, চলো, চলো, শিগগির চলল। লোকটা বেহাত হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে যে!
পাঁচুর হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে প্রায় দৌড়তে-দৌড়তে হিজিবিজি বলছিল, সর্বনাশ হয়ে যাবে! কোথায় সেই মজা পুকুর?
পাঁচু বিরক্ত হয়ে বলল, আহা, কোথায় আন্দাজে ছুটছ? পুকুর তো ডান ধারে।
পুকুরের ধারে এসে তারা দেখল, চারদিকে গাছগাছালির ঘন ছায়ায় নিথর পুকুর। কোথাও কোনও হুটোপাটির শব্দও নেই।
হিজিবিজি ব্যস্তমনস্ক হয়ে বলল, পুকুর থেকে ওকে তুলতেই হবে! জলে নামো। এর জন্য টাকা দেব।
পাঁচু বলল, পাগল নাকি? পুকুরে থকথকে কাদা, একবার নামলে আর উঠতে হবে না। জন্ম থেকে দেখে আসছি, এই পুকুরে কেউ নামে না। কলসি-কানাই তো এখানেই ডুবে মরেছিল।
হিজিবিজি হাসিখুসি ভাবটা উবে গেছে। সে কঠিন গলায় বলে, ওসব শুনতে চাই না। লোকটাকে পুকুর থেকে তুলতেই হবে। আমার কাছে ভালো নাইলনের দড়ি আছে। তোমার কোমরে বেঁধে দিচ্ছি। পুকুরে নামো, বিপদ বুঝলে আমি টেনে তুলব।
পাচু পিছিয়ে গিয়ে বলে, এই ঠান্ডায় আমি পুকুরে নামতে পারব না হিজিবিজিদাদা। নামতে হলে তুমি নামো।
হিজিবিজি হঠাৎ লোহার মতো শক্ত হাতে তার ঘাড়টা চেপে ধরে মাথায় একটা রামগাট্টা বসিয়ে দিয়ে বলল, ভালো কথায় কাজ না হলে তোর বিপদ আছে। ছুঁড়ে পুকুরে ফেলে দেব।
পাঁচু বুঝতে পারল, হিজিবিজিকে সে যত ভালোমানুষ মনে করেছিল, তত ভালোমানুষ ও নয়। গাট্টার চোটে তার মাথা ঝিমঝিম করে চোখে অন্ধকার দেখে বসে পড়ল মাটিতে।
হিজিবিজি কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা লম্বা নাইলনের দড়ি বের করে পাঁচুর কোমরে এক প্রান্ত বেঁধে দিয়ে বলল, যাও আর সময় নষ্ট কোরো না। কথা না শুনলে কিন্তু বিপদ হবে।
পাঁচু তবু ইতস্তত করতে লাগল। হিজিবিজি সোজা তার ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে পুকুরের ধারে গিয়ে প্রচণ্ড একটা ধাক্কায় জলে ফেলে দিল।
বরফের মতো ঠান্ডা জলে পড়ে গিয়ে পাঁচু মা গো বলে চেঁচিয়ে উঠল প্রথমে। তারপর পাগলের মতো হাত পা ছুঁড়তে লাগল। উপরে খানিকটা জল থাকলেও জলের দু-তিন ফুট নীচে ভসভসে কাদায় গেঁথে গেলে আর কিছু করার থাকে না। হিজিবিজি পুকুরের ধার থেকে কঠিন গলায় আদেশ দিল, ডুব দাও। ডুব দিয়ে দিয়ে খোঁজো লোকটাকে। দেরি কোরো না, তা হলে মরবে।
কিন্তু জলে-কাদায় ডুবন্ত মানুষ খুঁজবে কী, পাঁচুর নিজের প্রাণই রক্ষা করা দায়। সাঁতার সে খুবই ভালো জানে বটে, কিন্তু এই হাজামজা কাদার পুকুরে সাঁতার জেনে হবে কোন অষ্টরম্ভা? পাঁচু ভেসে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল বটে, কিন্তু উপর থেকে একটা গাছের শুকনো ডাল দিয়ে তার মাথায় একটা ঘা মেরে হিজিবিজি বলল, ডুব দাও। ডুব দিলে তুলবে কী করে লোকটাকে?
অগত্যা ডুব দিতে হল পাঁচুকে। আর ডুব দিতেই হল বিপত্তি। আর এই সাঙ্ঘাতিক ঠান্ডায় হাত-পা অসাড় হয়ে আসছিলই। ডুব দেওয়ার পর নীচেকার কাদামাটি ঘুলিয়ে উঠে নাকে-মুখে ঢুকে যাচ্ছিল। নীচের কাদায় বসে যাচ্ছিল কোমরসুদ্ধ পা। চেষ্টা করেও পাঁচু আর উপর দিকে উঠতে পারছিল না। তার উপর দমও ফুরিয়ে আসছে।
মরতে আজ খুব একটা দুঃখ হচ্ছে না পাঁচুর। এতদিনে সে বুঝতে পেরেছে এই অনাদরে, অপমানে বেঁচে থাকার মানেই হয় না। মরে বরং ভূত হয়ে দিব্যি গাছে-গাছে ঘুরে বেড়ানো যাবে। সেও একরকম ভালো। তাই আকুপাকু করলেও ভিতরে তেমন হায়-হায় করছিল না।