.
টকাই হেসে বলল, আর তোকে যাত্রার পার্ট করতে হবে না। মাথা ঠান্ডা কর। বরং বাঘে ধরলে মানুষ যে
প্রাণভয়ে চেঁচায়, সেটা একটু প্র্যাকটিস কর। আজ রাতে তোকে দিয়েই ওই পার্টটা করাব বলে ভাবছি। পারবি না?
খুব পারব ওস্তাদ। ওই তো বোশেখ মাসে হাবু দাসের উঠোনে মাঝরাত্তিরে চুরি করতে ঢুকে আমার পায়ের উপর দিয়ে একটা হেলে সাপ বেয়ে গিয়েছিল। কী চেঁচানটাই না চেঁচিয়েছিলাম বাপ! গাঁ-সুন্ধু লোক আঁতকে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল।
হ্যাঁ, ওইরকম চেঁচানো চাই। যা, দুর্গাপদকে খবর দিয়ে বাড়ি গিয়ে প্র্যাকটিস কর। সন্ধের মুখে তৈরি হয়ে চলে আসিস।
নবা এতদিন পর মনের মতো কাজ পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে মালোপাড়ায় গিয়ে দুর্গাপদকে খবর দিয়ে বাড়িতে ফিরে মা কালীকে বেজায় ভক্তিভরে পেন্নাম ঠুকল। ওস্তাদ টকাইকে যে ফের চাঙা করা গেছে, এটাই মস্ত লাভ।
সারাদিন নবা বাড়ির পাশের মাঠটায় বসে চেঁচানি প্র্যাকটিস করতে লাগল। কিন্তু ফল যা দাঁড়াল তা বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়। তার বাঁচাও বাঁচাও, মেরে ফেললে, খেয়ে ফেললে। চিৎকার শুনে লোকজন সব লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে আসতে লাগল। কিন্তু এসে কেউ কিছু বুঝতে পারল
উদ্ধববাবু বললেন, বলি ওরে নবা, তোর চেঁচানি শুনে তো মনে হচ্ছে তোকে বাঘেই ধরেছে। কিন্তু বাঘটা গেল কোথায়? বাঘ তোকে খেল, না তুই-ই বাঘটাকে খেয়ে ফেললি বাপ?
ভজহরিবাবু বললেন, রিখটার স্কেলে এই চেঁচানির মাপ হল সাড়ে ছয়। এরকম চেঁচালে বাঘ-সিংহের আত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার কথা।
শিবেন গম্ভীরভাবে বলল, শব্দের মাপ রিখটার স্কেল দিয়ে হয়না ভজহরিবাবু। ওটা হল ডেসিবেল।
গদাধর মাল ফুলিয়ে এগিয়ে এসে বলল, আরে বাঘফাঘ নয়, নবা ভূত দেখেছে। আজকাল এ গাঁয়ে বেশ ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে দেখছি।
ভজহরিবাবু প্রতিবাদ করে বললেন, কক্ষনো নয়। নবা মেরে ফেললে, খেয়ে ফেললে বলে চেঁচাচ্ছে। সায়েন্সে স্পষ্ট করে বলা আছে, ভূত কখনও মানুষ খায় না। ভূতের খাদ্য হল অক্সিজেন, হাইড্রোজেন আর নাইট্রোজেন।
গদাধর রোষকষায়িত লোচনে ভজহরির দিকে চেয়ে বলল, ভূতের মেনু আপনি কিছুই জানেন না। প্রায় রাতেই আমার মাংসের আখনি আজকাল ভূতে চেটেপুটে খেয়ে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, তারা হাড়টাড় চিবোতে পারে না বলে সেগুলো ফেলে যায়।
নবার বুড়ি মা এসে তাড়াতাড়ি ছেলেকে দু-হাতে আগলে ধরে বলল, ওগো, তোমরা ওসব অলক্ষুনে কথা বোলো না তো! বাছা আমার এমনিতেই ভিতুর ডিম। বাঘটাঘ নয় বাবারা, আমি জানি, নবাকে নিশ্চয়ই ভেঁয়োপিঁপড়ে কামড়েছে। বরাবর পিঁপড়ের কামড় খেয়ে ওই রকম করে চেঁচায়। নরম শরীর তো ব্যথা-বেদনা মোটেই সইতে পারে না।
মায়ের হাত ধরে নবা বাড়ি ফিরল বটে, কিন্তু সারা সকাল ঘণ্টাদুয়েক টানা চেঁচানোর ফলে বিকেলের দিকটায় টের পেল, গলাটা ফেঁসে গিয়ে কেমন যেন ভাঙা আওয়াজ বেরোচ্ছে। সর্বনাশ আর কাকে বলে! টকাই ওস্তাদ এই গলা শুনলে কি আর পার্টটা তাকে দেবে? যথারীতি সন্ধেবেলা কালীকে পেন্নাম ঠুকে বেরিয়ে পড়ল নবা। টকাইয়ের বাড়িতে দুর্গাপদও এসে জুটে গেছে। তিনজনে মিলে ঠিক কী করতে হবে তা ভালো করে বুঝে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
উত্তরের জঙ্গল-রাস্তা বড় কম নয়। ঠান্ডাটাও আজ যেন জোর পেয়েছে। উত্তুরে হাওয়া দিচ্ছে জোর। রাত আটটার মধ্যেই গা একেবারে নিঃঝুম। শীতের চোটে আর বাঘের ভয়ে রাস্তাঘাট শুনশান। তিনজনে পা চালিয়ে হেঁটে রাত নটার মধ্যেই উত্তরের জঙ্গলে পৌঁছে গেল। জ্যোৎস্না রাত নয়, তবে অন্ধকারেই তাদের চলাফেরার অভ্যাস বলে অসুবিধে হল না। জটাবাবার কুটিরের কাছাকাছি একটা ঝুপসি বটগাছ। তার আড়াল থেকে তারা জটাবাবার কুটিরে পিদিমের মিটমিটে আলোর আভাস দেখতে পেল।
টকাই দুর্গাপদকে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, দুর্গা, এইবার।
দুর্গাপদ মুখের কাছে দুই হাতের পাত ঠোঙা করে ধরে যে বাঘের ডাকটা ছাড়ল তা শুনলে বাঘ পর্যন্ত অবাক হয়ে যায়। কী গম্ভীর গর্জন রে বাবা। আকাশ বাতাস যেন প্রকম্পিত হয়ে গেল। টকাই নবাকে খোঁচা দিয়ে বলল, এবার তুই।
তা নবার পার্টও কিছু খারাপ হল না। দিব্যি বাঘের ধরা মানুষের মতো সে গলা সপ্তমে তুলে চেঁচাতে লাগল, বাপ রে, মা রে, খেয়ে ফেলল, মেরে ফেলল…! সেইসঙ্গে মুহুর্মুহু দুর্গার বাঘের ডাক।
বিস্তর বাঘ গর্জন আর মর্মন্তুদ আর্তনাদ করার পরও জটাবাবার কুটির থেকে কেউ উঁকি মারল না দেখে নবা মাথা চুলকে বলল, কী হল বলো তো ওস্তাদ! পার্টে কি কোনও ভুল হল?
দুর্গাপদ কাঁপা গলায় বলল, না রে, ভুল হয়নি। ওই যে…
দুর্গাপদ যেদিকে আঙুল তুলে দেখাল, সেদিকে চেয়ে নবা এবার পার্ট ভুলে সত্যিকারের প্রাণভয়ে চেঁচাতে লাগল, ওরে বাপ রে, মেরে ফেলল রে, খেয়ে ফেলল রে…
বাঘটা অবশ্য মোটেই উত্তেজিত হল না, তেমন ঘাবড়ালও না। জুলজুলে চোখে তাদের দিকে একটু চেয়ে থেকে, বোধ হয় দুর্গাপদকে মনে-মনে শাবাশ জানিয়ে একটা হাই তুলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
বাঘ চলে যাওয়ার পরও অবশ্য নবা চেঁচিয়েই যাচ্ছিল। টকাই একটা ধমক দিয়ে বলল, দ্যাখ নবা, বাঘেরও ঘেন্নাপিত্তি আছে। ওরা বেছেগুছেই খায়। তোর ঘাড় মটকালে কি ও ওর জাতভাইদের কাছে মুখ দেখাতে পারবে?