ওই তো বললুম, ঋষিবাক্য লঙঘন করা মহা পাপ। আমারও ডাকাতির আর্ষ নেই, বুঝলি? চুরি পর্যন্ত অ্যালাউ, কিন্তু ডাকাতি কখনও নয়।
এইবার জলের মতো বুঝেছি। আর-একটু বুঝলেই অন্ধকারটা কেটে যায়।
আর কী বুঝতে চাস?
ওই যে চুরি ছেড়ে আর-একটা কী যেন করার কথা ভাবছেন?
টকাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বড়ই গুহ্য কথা রে। তোকে বলা কি ঠিক হবে?
নবা করুণ গলায় বলল, না বললে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ধড়ফড় করে মরে যাব ওস্তাদ। গুহ্য কথা না শুনলে যে বড় মুহ্যমান অবস্থা হয় আমার।
তা হলে বলছি শোন। ওই জটাবাবা লোকটা সাধুফাদু কিছু নয়। ওই হিজিবিজি ছেলেটাও জালি। প্রথম দিন দেখেই আমার মনে হয়েছিল, ওদের অন্য কোনও মতলব অছে। জটাবাবার বেদিটা তো দেখেছিলি। তোর অবশ্য দেখার চোখ নেই। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, চট আর কম্বলে ঢাকা বেদিটা আসলে একটা বড়সড় কাঠের বাক্স। তোর যেমন দেখার চোখ নেই, তেমনই শোনারও কান নেই। থাকলে টের পেতিস, ওই ঘরখানায় ওই দুজন ছাড়া তৃতীয় আর-একজন কেউ ছিল। আমি তার শ্বাসের শব্দ পেয়েছি। তোকে বলেছিলাম সেই কথা। আমি তিন-চারদিন করে নিশুতি রাতে গিয়ে জটাবাবার আস্তানায় নজর রেখেছি। কী দেখেছি জানিস?
নবা বড়-বড় চোখ করে শুনছিল, বলল, কী ওস্তাদ?
নিশুতি রাতে ওরা ঢাকনা সরিয়ে কাঠের বাক্সটা থেকে একটা অদ্ভুত জীবকে বের করে। মানুষ বলে মনে হয় না, কিন্তু দেখতে আবার খানিকটা মানুষের মতোই। খুব বেঁটে, পেট আর বুক মিলিয়ে অনেকটা বলের মতো গোলাকার, মাথাটাও গোল। তবে নাক, মুখ, চোখ, সবই আছে। মনে হয় আজব জীবটাকে ওরা সারাদিন কড়া ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, রাত্তিরবেলা জাগায়। কিন্তু ওষুধের জন্য কিম্ভুত জীবটার ঘুম ভাঙতেই চায় না। তাই তাকে ওরা গরম লোহার শিক দিয়ে ছ্যাকা দেয়, থাপ্পড় মারে, নানা অত্যাচার করে।
এ তো খুব অন্যায় কথা ওস্তাদ! দেশটা যে অরাজকতায় ভরে গেল!
এখন মুখ বন্ধ রেখে শোন। ওই বেঁটে মানুষটা কথাটথা কয় কিনা আমি সেটা মন দিয়ে শুনবার চেষ্টা করেছি। মাঝে-মাঝে একটুআধটু কথাও বলে বটে, তবে অস্পষ্ট সব শব্দ। অং, বং, ফুস গোছের কিছু আওয়াজ। সেসব কথা ওই জটাবাবা আর তার চেলাও বুঝতে পারে না। তবে বেঁটে লোকটা মাঝে-মাঝে শিস দেওয়ার মতো ভারী সুন্দর সুরেলা শব্দ করতে পারে। এত সুন্দর শব্দ আমি জীবনে শুনিনি। প্রাণটা যেন ভরে যায়। রাত্তিরে বেঁটে লোকটাকে ওরা খেতেও দেয়। শুধু ফল ছাড়া সে অবস্য কিছুই খায়
। ফল বলতে শুধু আপেল, আঙুর নয়, তার সঙ্গে বটফল, নাটাফল, এসবও খায়। বেঁটে লোকটাকে ওরা কোথা থেকে ধরে এনেছে আর কী করতে চায়, সেটা রোজ হানা দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না। তবে লুকোছাপার বহর দেখে অনুমান করছি, ওদের মতলব ভাল নয়। তাই ভাবছি, আজ রাতে ওদের হাত থেকে ওই বেঁটে লোকটাকে উদ্ধার করব।
নবা মহা উৎসাহে বলে উঠল, তা হলে দলবল জোটাই ওস্তাদ? লাঠিসোঁটাও বের করি!
দূর বোকা! জটাবাবা আর তার চেলার অস্তর কিছু নেই? একদিন জটাবাবাকে দেখলাম, ঝোলা থেকে একটা ছোটখাটো বন্দুক গোছের জিনিস বের করে গুলির ফিতে পরাচ্ছে। হামলা করতে গেলে আঁঝরা করে দেবে। সব ব্যাপারেই মোটা দাগের কাজে ঝোঁক কেন তোর? মাথা খাটাতে পারিস না? মনে রাখবি, সব সময়েই গা-জোয়ারির চেয়ে বুদ্ধি খাঁটিয়ে কৌশলে কাজ উদ্ধার করাই ভালো।
তা হলে কী করতে হবে ওস্তাদ?
লক্ষ করেছি, জটাবাবা আর তার চেলা দুজনে সারাদিন পালা করে ঘুমোয়। একজন ঘুমোলে অন্যজন পাহারায় থাকে। দুজনের কেউ ঘর ফাঁকা রেখে যায় না। আর-একটা কথা হল, গেরস্তদের ফাঁকি দিয়ে বোকা বানানো যত সোজা, শয়তান লোকদের ঠকানো তত সোজা নয়। তার উপর এরা হল পাষণ্ড, খুনখারাপি করতে পেছপা হবে না। ভাবছি, আজ রাতে এমন একটা কাণ্ড করতে হবে, যাতে দুজনেই তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর..
নবা ডগমগ হয়ে বলে, সে তো খুব সোজা। ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলেই তো হয়।
দূর আহাম্মক! আগুন দিলে ওই জতুগৃহ চোখের পলকে ছাই হয়ে যাবে। তিনজনের কেউ বাঁচবে না। মনে রাখিস, আমরা চোর হলেও খুনি নই কিন্তু! ওসব পাপ চিন্তা করবি তো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেব।
আজ্ঞে, ভুল হয়ে গেছে ওস্তাদ! আর এ কথা মনেও আনব না। তা মতলবটা কী ভঁজলেন?
ভাবছি, ইদানীং ময়নাগড়ে খুব বাঘের উৎপাত হয়েছে। আমাদের দুর্গাপদ চমৎকার বাঘের ডাক নকল করতে পারে। তাকে দিয়ে কাজ হাসিল হয় কিনা!
আজ্ঞে, খুব হয়। আমি চললুম দুর্গাপদকে খবর দিতে।
ওরে, অত উতলা হোসনি। ওরা জঙ্গলে থাকে, বাঘের ডাক কিছু কম শোনেনি। তবে শুধু বাঘের গর্জন নয়, সেইসঙ্গে মানুষের আর্তনাদ মিশিয়ে দিলে কাজ হতে পারে। ভাবটা এমন হতে হবে, যাতে মনে হয়, কোনও লোককে বাঘে ধরেছে। তাতে ওরা একটু চমকাবে। নিশুত রাতে উত্তরের জঙ্গলে মানুষের গতিবিধি তো স্বাভাবিক নয়। ওরা ধরে নেবে যে, নিশ্চয়ই ওদের উপর চড়াও হতে এসে বাঘের খপ্পরে পড়ে গেছে। সরেজমিনে দেখার জন্য ওরা অস্তর নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে, বুঝেছিস?
হেঃ হেঃ, একেবারে জলের মতো। চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখতেও পাচ্ছি ওস্তাদ। ওই তো জটাবাবা বেরিয়ে এল, হাতে মেশিনগান, চোখ দুখানা ধকধক করছে, আর ওই যে পিছনে হিজিবিজি, তারও হাতে পিস্তল। জটাবাবা হাঁক মারল, কে রে? কার এত বুকের পাটা যে সিংহের গুহায় ঢুকেছিস…?