জন্য কি আর ওটুকু কাজ আমিই করে রাখতুম না!
নবা ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না, না, কষ্ট কীসের? আমরা হলুম গে মেহনতি মানুষ! খেটেই খেতে হয় কিনা।
না ভাই, ওটা কোনও কাজের কথা নয়। এই আমাদের মতো অধম লোকেরা থাকতে আপনার মতো গুণী মানুষেরা কষ্ট করবেন কেন? আপনি হলেন শিল্পী মানুষ। কী পাকা হাত আপনার! চোখ জুড়িয়ে যায়। একটুও শব্দ হল না, একটা ভুল হল না, নিখুঁতভাবে ছিটকিনি নেমে গেল, বাটাম খুলে গেল। আমি তো আগাগোড়া মুগ্ধ হয়ে দেখছিলুম। কী বলব ভাই, নিতান্ত বয়সে আপনি ছোট, নইলে আমার খুব পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছে।
কথাবার্তা বেশ উচ্চগ্রামেই হচ্ছিল। নিশুত রাতে কথাবার্তার শব্দ উঁচুতে উঠলে বাড়ির লোকের ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা। আর সেরকম লক্ষণ টেরও পাচ্ছিল নবা। এপাশ ওপাশের ঘর থেকে সাড়াশব্দ হতে লেগেছে। কে যেন বলে উঠল, ও ঘরে কাঁদের কথাবার্তা হচ্ছে?
একজন মহিলা কাকে যেন ঘুম থেকে ঠেলে তুলছেন, ও পটল, ওঠ, ওঠ, তোর বাবার ঘরে কী হচ্ছে দ্যাখ তো গিয়ে!
নবা বেগতিক বুঝে তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, তা হলে নন্দবাবু, আজ বরং আসি। আজ আপনি ব্যস্ত আছেন তো, বরং আর-একদিন আসা যাবে…!
নন্দবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, সে কী ভাই, এখনই যাবেন কী? ভালো করে আপ্যায়ন করা হল না, অভ্যর্থনা হল না, পরিচয় অবধি হয়নি, এক কাপ চা খেলেন না, সঙ্গে দুটো মুচমুচে বিস্কুট, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা হল না, এখনই কি ছাড়া যায় আপনাকে? দুঃখ দেবেন না ভাই, বরং জুত করে বসুন।
নবা শশব্যস্তে বলে উঠল, বসার জো নেই নন্দবাবু, আমার পিসির এখন-তখন অবস্থা, আজ আর চাপাচাপি করবেন না, একটা ভালো দিন দেখে বেড়াতে-বেড়াতে চলে আসবখন…
বলেই পট করে দরজাটা খুলে বেরিয়ে ছুট লাগাল নবা। পিছনে অবশ্য নন্দবাবু চেঁচাচ্ছিলেন, ও ভাই, ও চোরভাই, আবার আসবেন কিন্তু ভাই, বড় দুঃখ দিয়ে গেলেন।
তা নবার এখন বেশ দুঃসময়ই যাচ্ছে। টকাই ওস্তাদ গতর না নাড়লে এমনই চলবে।
সকালবেলাতে গিয়েই সে টকাইয়ের বাড়িতে থানা গেড়ে বসল। বলল, ওস্তাদ, কাজকর্ম যে বড় ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে। আপনি গতর না নাড়লে যে রাজ্যপাট সব আনাড়ি চোরছ্যাচড়াদের হাতে চলে যাবে। কাঁচা হাতের মোটা দাগের কাজ দেখে লোকে যে ছ্যাঃ ছ্যাঃ করতে লেগেছে।
টকাই সকালের দিকে একটু সাধনভজন করে। একটু ব্যায়াম-প্রাণায়ামও করতে হয়। সেসব সেরে সবে একটু বসে জিরোচ্ছিল। নবার দিকে চেয়ে ভু কুচকে বলল, কাল রাতে কারও বাড়িতে ঢুকেছিলি বুঝি?
নবা লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে ঘাড়টাড় চুলকে বলল, ওই একটু ছোটখাটো কাজ, হাত মকশো করতেই গিয়েছিলাম ধরে নিন।
সুবিধে হল না বুঝি?
আজ্ঞে, ঠিক তা নয়। কাজের বেশ প্রশংসাই হয়েছে। নন্দগোপালবাবু তো খুব বাহবাই দিলেন। ফের আর-একদিন যেতেও বলেছেন।
টকাই বিস্মিত হয়ে বলে, নন্দগোপাল! হুঁ! যে চোরের আক্কেল আছে, সে কখনও নন্দগোপালের ঘরে ঢোকে?
কেন ওস্তাদ?
বিগলিত ভাব দেখে ভুলেও ভাবিসনি যে, নন্দগোপাল সোজা পাত্তর। ও হল পুলিশের আড়কাঠি। সারা গায়ের সব খবর গিয়ে থানায় জানিয়ে আসে। তোর নামধাম, নাড়িনক্ষত্র সব তার খাতায় টোকা আছে। আজই যদি পুলিশ তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাটকে পোরে, তা হলে অবাক হোস না।
ও বাবা! তবে কী হবে ওস্তাদ? চোরধর্ম বলে একটা কথা আছে জানিস? চোরদের অনেক রাছবিচার করে কাজে নামতে হয়। যার-তার বাড়িতে গিয়ে হামলে পড়লেই তো হল না! কার চৌকাঠ ডিঙোতে নেই, কার কাছ থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে হয়, কার ছায়া মাড়াতে নেই, সে সমস্ত শেখার জিনিস, বুঝলি?
যে আজ্ঞে। তবে আপনি এই কম বয়সেই রিটায়ার নিয়ে নেওয়ায় আমি যে বড় বিপদে পড়েছি ওস্তাদ। এখনও কত কী হাতেকলমে শেখা বাকি রয়ে গেছে। সিলেবাস তো এখনও অর্ধেকই শেষ হয়নি। কোচিং-এ বেজায় ফাঁক পড়ে যাচ্ছে যে!
রিটায়ার করেছি তোকে কে বলল? এ সব পাপ কাজে একটু অনিচ্ছে এসেছে ঠিকই, তবে অন্য দিকে কাজ বেজায় বেড়ে গেছে।
নবার চোখ চকচক করে উঠল, তা হলে কি চুরি ছেড়ে ডাকাতি ধরে ফেললেন ওস্তাদ? আহা, ডাকাতি বড় জব্বর জিনিস। আমার মনের মতো কাজ। চরিতে বড় মগজ খেলাতে হয়, হাত মশা করতে হয়, গেরস্তের হাতে হেনস্থা হওয়ারও ভয় থাকে। ডাকাতি একেবারে খোলামেলা জিনিস। বন্দুক-তলোয়ার নিয়ে জোকার দিয়ে পড়ো, চেঁছেপুঁছে নিয়ে এসো। গেরস্ত ভয়ে ঘরের কোণে বসে ইষ্টনাম জপ করবে আর হাতে-পায়ে ধরে প্রাণ ভিক্ষে চাইবে। সে-ই। ভালো ওস্তাদ! পাকা চোর হওয়ার অনেক মেহনত, অনেক হ্যাপা। ডাকাতি একেবারে জলের মতো সোজা কাজ।
ওরে মুখ, ডাকাতির নামে নাল গড়াচ্ছে! বলি, আর্ষ কাকে বলে জানি?
আজ্ঞে না ওস্তাদ!
আর্ষ মানে হল ঋষির দেওয়া নিদান। প্রত্যেক বংশেরই আদিতে একজন করে মুনি বা ঋষি থাকেন। আর্য হল সেই ঋষির দেওয়া বিবিধ ব্যবস্থা। এই যে পাঁচকড়িবাবুর বাড়িতে কাসুন্দি তৈরি নিষেধ, ওই যে উদ্ধববাবুর বাড়িতে শোল বা বোয়াল মাছ ঢোকে না, এই যে ভজহরিবাবুদের বংশে দুর্গাপুজো হয় না, সে কেন জানিস? আর্য নেই বলে। ওদের মুনি-ঋষিরা ওসব নিষেধ করে গেছেন।
নবা একটু ভাবিত হয়ে বলল, তাই বটে ওস্তাদ। আমার বাড়িতে কেউ কখনও পুব দিকে রওনা হত না। পুব দিকে যেতে হলে আগে পশ্চিম দিকে রওনা হয়ে তারপর ঘুরপুথে পুব দিকে যেত। আমরা পুব দিকে গেলে নাকি ঘোর অমঙ্গল। তা অমি যেমন ভুলে মেরে দিয়েছি বলেই কি আমার কিছু হচ্ছে না ওস্তাদ?