বিষ্ণু খুব অভিমান করে বলল, আমার খাওয়াটাই বেশি দেখলি রে পাঁচু! বেহান থেকে শুরু করে সুয্যি পাটে নামা অবধি আমাকে কখনও কুটোগাছটি দাঁতে কাটতে দেখেছিস? সারাদিন উপোসি পেটে পড়ে-পড়ে ঘুমোই, এই নিশুত রাতেই যা দুটি পেটে যায়। খাওয়াটা দেখলি আর উপোসটা দেখলি না?
তা আজ রাতেও পাঁচুর ঘুম আসছিল না। তার তক্তপোশের নীচে যে কেলো কুকুরটা থাকে, সেটা মাঝে মাঝে কেন যেন খ্যাক খ্যাক করে উঠছিল। থানার পেটা ঘড়িতে যখন ঢংঢং করে রাত দুটো বাজল, তখন হাই তুলে উঠে বসে রইল পচু। আজ বড্ড শীত পড়েছে, ছেঁড়া কম্বলে শীত মানছে না। ঠান্ডায় হাত-পায়ে ব্যথাও হয়েছে খুব। চারদিকে ঘন কুয়াশা, অন্ধকার। তবে পাঁচু অন্ধকার আবছায়াতেও অনেক কিছু দেখতে পায়। তার চোখ খুব ভালো। কানও সজাগ। গাছের পাতা খসলেও সে টের পায়।
ঘণ্টার রেশ মিলিয়ে যাওয়ার পরই সে সামনের রাস্তায়। যেন একজোড়া খুব হালকা পায়ের শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা এতই ক্ষীণ যে, অন্য কেউ টেরই পাবে না। রাতে যারা ঘোরাফেরা করে তাদের পায়ের শব্দ পাঁচু খুব চেনে। কিন্তু এটা চেনা শব্দ নয়। দক্ষিণ থেকে কেউ উত্তরমুখো যাচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে বেশ, ধীরেসুস্থে, যেন বেড়াতে বেরিয়েছে।
পাঁচু বিছানা থেকে নেমে বারান্দা পেরিয়ে সামনের জমিটা ডিঙিয়ে রাস্তায় উঠে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। দেখল, খুব বেঁটেমতো গোলাকার চেহারার একটা কিম্ভুত কিছু দুলে-দুলে আসছে। কাছে আসতেই ভারী অবাক হয়ে গেল পাঁচু। মানুষ নাকি? এ কীরকম ধারা মানুষ?
কাছাকাছি আসতেই বস্তুটাকে দেখতে পেল পাঁচু। চোখ কচলে ফের ভালো করে তাকিয়ে দেখল, বস্তুটা মানুষের মতো নয়, আবার মানুষ বললেও ভুল হয় না। বুক, পেট, সব যেন একটা গোলাকার বলের মতো। তার উপরে বেজায় বড় একটা মুণ্ডু, দুখানা বেঁটে পা, দুখানা ছোট ছোট হাত, এরকম বেঢপ মানুষ পাঁচু কখনও দেখেনি।
হাঁটতে-হাঁটতে মানুষটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে চারদিকটা চেয়ে দেখে নিল। আর সেই সময় মুভুটা দিব্যি ডাইনে-বাঁয়ে পাক খেল। ঘাড় না থাকলেও মুণ্ডু যে এমন ঘুরতে পারে, তা
দেখলে বিশ্বাস হয় না। চারদিকটা দেখে মানুষটা হঠাৎ শিসের মতো একটা সরু শব্দ করল। ভারী মিঠে সুরেলা শব্দ। অনেকটা বাঁশির মতো। সুরটা পাঁচুর চেনা সুর নয়। কিন্তু এতই সুন্দর যে, শুনলে প্রাণ-মন ভরে যায়। অল্প একটু শুনেই পাঁচুর যেন ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল।
একটু দাঁড়িয়ে মানুষটা আবার হেলেদুলে হাঁটতে শুরু করল। আর শিস দিচ্ছে না। একটু দূর থেকে পাঁচু নিঃশব্দে লোকটার পিছু নিল। লোকটা মাঝে-মাঝে দাঁড়াচ্ছে, শিস দিচ্ছে, ফের হাঁটছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না পাঁচু। কিন্তু কে জানে কেন, লোকটাকে তার খারাপ বলেও মনে হচ্ছে না।
টকাই ওস্তাদের বৈরাগ্য এসে গেল কিনা তা বুঝতে পারছে না নবা। জটাবাবার দয়াতেই কি এসব হয়েছে? আজকাল কাজকর্মের দিকে ওস্তাদের নজরই নেই। রাত্রি দশটা বাজতে না-বাজতেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর নাক ডাকিয়ে সে কী ঘুম রে বাবা! তা এরকম চললে নবার যে হাঁড়ির হাল হবে, তা কি ওস্তাদ বুঝতে পারছে না? মুশকিল হল যে, এতকাল টকাইয়ের শাগরেদগিরি করেও তেমন মানুষ হয়ে ওঠেনি। একা-একা কাজকর্ম করতে গেলেই নানা ভজঘট্ট বেধে যায়। এই তো পরশুদিন খগেনবাবুর বাড়িতে হানা দিয়ে ভারী অবাক হয়ে দেখল, দক্ষিণ দিকের ঘরখানার জানলার পাল্লা খোলা আর গ্রিলটা ভারী নড়বড় করছে। একটু টানাটানিতেই সেই গ্রিলখানাও ঝুলে পড়ল। সুবর্ণ সুযোগ আর কাকে বলে! নবা টুক করে জানলা গলে ঘরে ঢুকে পড়ল।
ভগবান যে আছেন তা মাঝে-মাঝে বড্ড বেশি টের পাওয়া যায়। কারণ, নবা অবাক হয়ে দেখল তাকে মেহনত থেকে বাঁচাবার জন্যই যেন ছিটকিনি নেমে গেল। নবা বাটামটাও খুলে ফেলল। একটুও শব্দ হয়নি। পরিষ্কার হাতে পরিপাটি কাজটি করে ফেলতে পেরে ভারীত খুশি হল সে। হ্যাঁ, টকাই ওস্তাদের শাগরেদের যোগ্য কাজই বটে! দরজা ঠেলে সামান্য ফাঁক করে সরু হয়ে ঢুকে পড়ল সে। ঢুকেও বেশ খুশিই হল সে। ঘরে দিব্যি হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে, অন্ধকারে হাতড়ে মরার দরকার নেই। ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে কাজে হাত দিতে গিয়ে একটু চক্ষুলজ্জায় পড়ে যেতে হল নবাকে। কারণ, দেখতে পেল, নন্দবাবু মশারির ভিতরে বিছানায় বসে জুলজুল করে তার দিকেই চেয়ে আছেন।
নবা লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকে নতমুখে বলল, এই একটু এসে পড়েছিলাম আরকি এদিকে!
নন্দবাবু শশব্যস্তে বলে উঠলেন, আস্তাজ্ঞে হোক, আস্তাজ্ঞে হোক। আসবেন বইকী ভাই, এ আপনার নিজের বাড়ি বলে মনে করবেন, কী সৌভাগ্য আমার! তা ভাই আপনি কে বলুন তো, কোথা থেকে আসছেন? এই শীতের রাতে ঠান্ডায় কষ্ট হয়নি তো!
ফাপরে পড়ে নবা আমতা-আমতা করে বলল, তা ঠান্ডাটা খুব পড়েছে বটে মশাই! তবে কিনা বিষয়কৰ্ম বলে। কথা! ঠান্ডা গায়ে মাখলে কি আমাদের চলে?
বটেই তো! বটেই তো! তবে মাফলার বা বাঁদুরে টুপিতে মাথাটাথা একটু ঢেকেঢুকে তো আসতে হয় ভাই! পট করে আবার ঠান্ডা না লেগে যায়। তার উপর বাইরে ওই শীতে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কত কষ্ট করে শিক দিয়ে পরদা ফাঁক করতে হল, তার দিয়ে ছিটকিনি খুলতে হল, সুতো বেঁধে বাটাম নামাতে হল, তা এত কষ্ট করার কী দরকার ছিল ভাই? আগে থেকে একটা খবর দিয়ে রাখলে আপনার