তা নয় করছি। কিন্তু তা বলে বিপ্লব তেমন খারাপ জিনিস নয়। বিপ্লবটিপ্লব করলে বেশ গা গরম হয় শুনেছি। তবে বস্তুটা কী, তা আমি অবশ্য জানি না।
আমিও জানি না ভজহরি। ওসব কথা মনে করে কষ্ট পেও না। তুমি তো জানোই ভাই, তোমার মতো ক্ষমতা আমার নেই। তোমার গায়ের জোর বেশি, অনেক কায়দাকানুন জানো। ছদ্মবেশ ধরতে পার। তার উপর তোমার পকেটে পিস্তল আছে। তোমার সঙ্গে কি আমি এঁটে উঠব ভাই! দোহাই তোমার, এই অসহায় বন্ধুর কাছ থেকে তার শেষ সম্বল এই থিসিসটা কেড়ে নিও না।
আহা, উত্তেজিত হচ্ছ কেন শিবেন? একটু ভাবতে দাও, তোমার কথা শুনে তোমার জন্য আমার বেশ মায়া হচ্ছে। ওরেবাপু, আমি তো আর পাষণ্ড নই।
সেটা আমিও জানি ভজহরি। তুমি বেশ ভাল লোক। তাই বলছি, এমন কাজ কোরো না। করলে তোমাকে লোকে খারাপ বলবে। আর লোকে তোমাকে খারাপ বললে, আমি যে মনে বড় ব্যথা পাব ভাই।
আহা, তোমার কথা শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায় হে শিবেন। তা হলে থিসিসটা তুমি হাতছাড়া করতে চাও না,
এই তো?
হ্যাঁ ভজহরি।
তা হলে যে আমার একটু উপকার করতে হবে শিবেন?
কী উপকার ভজহরি? দরকার হলে আমি তোমার পা টিপে দিতে পারি, মাথার উকুন বেছে দিতে পারি, কুয়ো থেকে তোমার স্নানের জল তুলে দিতে পারি, তোমার এঁটো বাসন মাজতে পারি, পঞ্চাশ টাকা ধার দিতে পারি।
অতটা না করলেও চলবে শিবেন। আপাতত তুমি একটা সহজ কাজই বরং করো।
কী করতে হবে ভজহরি?
এই রাজবাড়িতে পানিঘর বলে একটা ঘর আছে, জানো?
না তো!
আছে। মাটির নীচে একটা অন্ধকার ঠান্ডামতো ঘর, যেখানে মস্ত বড়-বড় জালায় গরমকালে রাজবাড়ির লোকেদের জন্য খাবার জল রাখা হত। আমি অনেক খুঁজেও ঘরটার সন্ধান পাচ্ছি না। তোমাকে সেই ঘরটা খুঁজে বের করে দিতে হবে।
কেন ভজহরি, তোমার কি খুব তেষ্টা পেয়েছে ভাই? যদি পেয়ে থাকে তো বলল, আমি তোমাকে জল এনে দিচ্ছি। টাটকা জল ছেড়ে পানিঘরের পুরোনো পচা জল খাওয়ার দরকার কী তোমার? শেষে পেটটেট খারাপ করবে! এই শীতে কি বেশি ঠান্ডা খাওয়া ভালো?
কথাটা মন্দ বলোনি শিবেন! খুব যুক্তিযুক্ত কথাই। তবে আমার তেষ্টাটাও খুব বেয়াদব তেষ্টা। সাধারণ জলে ও তেষ্টা মেটার নয়। পানিঘরের পুরোনো জলের সন্ধানেই আসা কিনা! ঘরটার সন্ধান যে আমার চাই।
শিবেন মিইয়ে গিয়ে বলল, রাজবাড়ির ভিতরকার সুলুকসন্ধান যে আমি জানি না ভজহরি, জানে শ্যামাদা। কিন্তু সে বড্ড তেরিয়া লোক। রাজবাড়ির ভিতরকার খবর তার কাছ থেকে বের করা খুব শক্ত। বাড়িখানা সে যমের মতো আগলে রাখে। আমাকে অবধি ঢুকতে দেয় না।
তা হলে তো বড় মুশকিল হল শিবেন। পানিঘরের সন্ধান না পেলে যে অনিচ্ছের সঙ্গেই তোমার থিসিসটা আমাকে কেড়ে নিতে হবে।
আঁতকে উঠে শিবেন বলে, না, ভাই না। কী করতে হবে বলো, করছি।
শোনো শিবেন, গরুর বাটে যে দুধ থাকে তা কি সে এমনিতে দেয়? গরুর বাঁটের নীচে বালতি পেতে রাখো, সাধ্যসাধনা করো, দুধ দেওয়ার পাত্রীই সে নয়। কিন্তু বাঁট ধরে চাপ দাও, দেখবে দুধের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এই যে সবাই জানে, ধানের ভিতরে চাল থাকে, কিন্তু ধান কি চালকে ছাড়তে চায় সহজে? কেঁকিতে ফেলে ধানের উপর চাপ সৃষ্টি করো, দেখবে, কেমন হাসতে-হাসতে চাল বেরিয়ে পড়েছে। এই ধরো না কেন, টিউবের মধ্যে যে টুথপেস্ট থাকে, এমনিতে বেরোয় কি? টিউবের ঘাড় ধরে চেপে দাও, দেখবে, সড়াক করে পেস্ট বেরিয়ে পড়বে।
শিবেন একমত হয়ে বলল, সে তো ঠিক কথাই হে। ভজহরি। চারদিকে তো চাপেরই জয়জয়কার দেখছি। গরম ইস্তিরি দিয়ে চেপে ধরলে কোচকানো কাপড় যেমন সটান হয়ে যায়, ফেঁড়া টনটন করছে তো চেপে ধরো, পুচ করে পুঁজ বেরিয়ে ব্যথার আরাম হয়ে যাবে। এই তো সেদিন একটা কাকড়াবিছে চটি দিয়ে চেপে ধরলুম, ব্যাটা চ্যাপটা হয়ে গেল। না হে ভজহরি, যে যত চেপে ধরতে পারে তারই তত সুবিধে।
হ্যাঁ শিবেন, চাপ দিতে জানলে সব কাজ হয়। তাই বলছিলাম, তুমিও যদি শ্যামাচরণের উপর একটু চাপ সৃষ্টি করতে পার, তা হলে পানিঘরের কথা সে লক্ষ্মীছেলের মতো বলে দেবে।
কিন্তু কীরকমভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে ভজহরি? তার বুকের উপর হাঁটু গেড়ে বসতে হবে কি?
হুঁ, সে প্রস্তাবও মন্দ নয় বটে। তবে কী জানো? শ্যামাচরণ বুড়ো মানুষ। তার উপর রোগাভোগা। তোমার মতো একটা দশাসই লোক বুকে চেপে বসলে হিতে বিপরীত হতে পারে তো! শ্যামাচরণ পটল তুললে পানিঘরের হদিশ দেবে কে?
তাই তো ভজহরি, আমার ওজন যে দু-মন দশ সের, সেই কথাটা মনে ছিল না। তা হলে কি গাঁ থেকে একটু হাল্কা দেখে কাউকে ডেকে আনব ভজহরি?
তুমি খুবই বুদ্ধিমান হে শিবেন। তবে কিনা অন্য কেউ শ্যামাচরণের উপর চাপ সৃষ্টি করতে না-ও চাইতে পারে। যাই হোক, এ-ব্যাপারে অন্য কাউকে চাপাচাপি করার দরকার নেই। তুমি বরং একটা কাজ করো, আমার পিস্তলটা নিয়ে যাও। চাপ সৃষ্টি করার পক্ষে এটা খুবই ভালো জিনিস।
কিন্তু ভাই, পিস্তল দিয়ে আমি যে কোনওদিন চাপ সৃষ্টি করিনি। কী করে করতে হয় তাও জানি না।
তোমাকে কিছুই করতে হবে না শিবেন। পিস্তল নিজেই চাপ সৃষ্টি করবে। তুমি শুধু জুতমতো বাগিয়ে ধরে কঠিন গলায় বলবে, পানিঘরের সন্ধান যদি না দাও, তা হলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।