বাঘটা বেশ মন দিয়েই তার কথা শুনছে বলে শিবেনের মনে হল। তার কাকুতি মিনতিতে কাজও শুরু হল। বাঘ ওরফে ভজহরি লম্বা লকলকে জিভটা দিয়ে ঠোঁট দুটো একবার ভালো করে চেটে নিয়ে চারদিকে একবার অলস চোখে তাকাল। তারপর প্রকাণ্ড একটা হাই তুলে ধীরেসুস্থে শিবেনের বুক থেকে পা দুটো নামিয়ে দুলকি চালে ডান ধারে চলে গেল।
শিবেনেরও হঠাৎ যেন সন্দেহ হচ্ছিল, বাঘটা নির্যস বাঘই, ভজহরি নয়। ভজহরি হলে বিপদ ছিল। শিবেন একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে উঠে পড়ল।
রাজবাড়িটাকে শ্যামাচরণ বুকে আগলে রাখে। কুটোগাছিও নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। প্রতি সপ্তাহে সে ঘরদোর পরিষ্কার করে, জিনিসপত্র যা আছে, সব যত্ন করে সাজিয়ে রাখে। সব জানলা-দরজার পাল্লা সেঁটে বন্ধ করে দিয়ে সদর দরজায় সেকেলে মজবুত বিরাট তালা ঝুলিয়ে দেয়। আপাতদৃষ্টিতে রাজবাড়িকে দুর্ভেদ্য মনে হলেও, শিবেন জানে, পিছন দিকে কর্তাদের তামাক সাজবার জন্য হুঁকোবরদারের একখানা ঘর আছে। সেই ঘরে জানলার একটা পাল্লার কঞ্জা ভাঙা। সেটা ঠেকনা দিয়ে লাগানো থাকে। যে খবর রাখে তার পক্ষে সেই জানলার পাল্লা সরিয়ে ভিতরে ঢোকা শক্ত ব্যাপার নয়।..
কাজটা শিবেনের পক্ষেও শক্ত হল না। জানলার পাল্লা সরিয়ে সে চৌকাঠে ঘোড়ায় চাপার মতো করে উঠে পড়ল। তারপর পাল্লাটা ফের জায়গামতো বসিয়ে অন্ধকার ঘরটা পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত একটা বড় ঘুরে ঢুকে পড়ল। এটা ছিল কর্তাদের খাসচাকরের ঘর। অন্ধকারে শিবেনকে আন্দাজ করে এগোতে হচ্ছে। বাইরে যা-ও একটু আলো ছিল, ঘরে একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। তার পকেটে একটা খুদে টর্চ আছে বটে, কিন্তু তার ব্যাটারি ফুরিয়ে এসেছে। নিতান্ত বিশেষ প্রয়োজনেই সেটা জ্বালাতে হবে।
সামনে দরবারঘরের আগে রানি-দরবার। এ ঘর থেকে রানিমা এবং রাজবাড়ির অন্যান্য বউ-ঝিরা দরবারের কাজকর্ম দেখত চিকের ফাঁক দিয়ে। এখনও কিছু ছেঁড়া চিক ঝুলে আছে।
শিবেন দরবার ঘরে পা দিতেই সামনের অন্ধকার থেকে কে যেন বেশ আহ্লাদের গলায় বলে উঠল, শিবেন যে!
শিবেনের হৃৎপিণ্ডটা একখানা বড় লাফ মেরেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। শিবেন শক্ত হয়ে, ঠান্ডা হয়ে, কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!
গলাটা ফের আহ্বাদের সঙ্গে বলে উঠল, আহা, ভয় পেয়ে গেলে নাকি হে শিবেন?
শিবেন কাঁদো-কাদো হয়ে বলে উঠল, এটা কি ভালো হচ্ছে ভজহরি?
গলাটা একটু যেন বিস্মিত হয়ে বলল, ভজহরি! আচ্ছা বেশ, তাই সই! না হয় ভজহরিই হলাম। কিন্তু তাতে ভয়ের কী আছে হে শিবেন? ভজহরি কি তোমাকে কামড়ে দেবে?
না ভজহরি, তুমি আঁচড়ে দাও, কামড়ে দাও, তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু তুমি তো আর সেইজন্য আসোনি। তুমি এসেছ আমার চার বছরের হাড়ভাঙা খাটুনিটা নষ্ট করে দিতে। তোমার অনেক গুণ ভজহরি, তা বলে আমার সঙ্গে এই শত্রুটা করাটা কি তোমার ঠিক হচ্ছে?
তাই তো হে শিবেন, এ কথাটা তো ভেবে দেখতে হবে।
তাই তো বলছি ভজহরি, একটু তলিয়ে ভেবে দ্যাখো! তোমার ভয়ে আমি এই ধাঁধাড়া ময়নাগড়ে চাকরি নিয়ে পালিয়ে এসেছি, তবু তুমি আমার পিছু ছাড়োনি! পায়ে পড়ি ভাই, আমার আর যা ক্ষতি করো কিছু মনে করব না। কিন্তু আমার এই সাধনা, এই অধ্যবসায়কে নষ্ট করে দিও না।
আহা তোমার কথা শুনে যে আমারই কান্না পাচ্ছে হে শিবেন! কিন্তু আমি তো তোমার উপকার করতেই এসেছি।
তা তোমার বগলে ওটা কী বস্তু বলো তো!
শিবেন তার থিসিসের ফাঁইলটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল, না, না ভজহরি, এটার দিকে নজর দিও না। আমি কিন্তু কিছুতেই এটা তোমাকে কেড়ে নিতে দেব না! দরকার হলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব, চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব, চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে দেব, গুলি চালাব, বিপ্লব করব…
গলাটা খুবই সমবেদনার সঙ্গে বলল, আহা, প্রথমেই অতটা করার দরকার কী শিবেন? সব কি একসঙ্গে পেরে। উঠবে হে? বলি, রক্তগঙ্গা যে বওয়াবে, তা অত রক্ত পাবে কোথায়? আমি নিতান্ত রোগাভোগা মানুষ। আমার শরীরে তিন-চার ছটাকের বেশি রক্তই নেই। চেঁচিয়ে যে লোক জড়ো করবে, তা লোকই বা আসবে কোত্থেকে? ধারেকাছে তো একমাত্র বুড়ো, শুটকো শ্যামাচরণ ছাড়া জনমনিষ্যিই নেই। আর আগুন যে জ্বালাবে, তোমার পকেটে তো দেশলাইও নেই হে! গুলি চালানোর কথা ভাবছ, বেশ ভালো কথা! কিন্তু বন্দুক, পিস্তল কি আর ভালো জিনিস হে! বেমক্কা ফেটেফুটে গিয়ে বিপত্তি বাধিয়ে বসবে। জোগাড় করাও ভারী শক্ত। এই যে দ্যাখো না, আমার পকেটে একখানা আছে! নেহাত মেহনত করে জোগাড় করতে হয়েছে ভায়া, এক কাড়ি টাকা দণ্ড দিয়ে।
কাঁপা গলায় শিবেন বলে, তোমার পিস্তল আছে ভজহরি! ছিঃ, ভাই ছিঃ, বন্ধু হয়ে তুমি বন্ধুর কাছে পিস্তল নিয়ে এসেছ! শেষ অবধি তোমার হাতেই আমাকে প্রাণ দিতে হবে নাকি? তা না হয় দিলুম, কিন্তু তোমার যে খুব পাপ হয়ে যাবে ভজহরি!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কণ্ঠস্বরটি বলল, সেটাই তো চিন্তার কথা হে শিবেন। পাপ জিনিসটাকে আমি বড় ভয় পাই। পাপটাপ করতে আমার মোটেই ইচ্ছে হয় না। তাই তো আমি লোককে বলি, যা করো তা করো ভাই, কিন্তু আমাকে দিয়ে কোনও পাপ কাজ করিও না। তবে তুমি যেন বিপ্লবের কথাও বলছিলে!
হ্যাঁ ভাই ভজহরি, আমি বিপ্লবের কথাও বলেছি। ঘাট হয়েছে ভাই, রাগের বশে বলে ফেলেছি, মাপ করে দাও।