দুশ্চিন্তায় শিবেনের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার রিসার্চের কাজ প্রায় শেষ। জমা দিলেই ডক্টরেট। কিন্তু তীরে এসে তরী না ডোবে! ভজহরির ভয়েই সে ময়নাগড়ের মতো অজ্ঞাত পাড়াগাঁয়ে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু দুর্দম, ডাকাবুকো ভজহরিকে ঠেকাতে পারল কি?
রাতে বারোখানা রুটি খায় শিবেন। আজ উদ্বেগে উকণ্টায় ছখানার বেশি পারল না। রোজ বালিশে মাথা রাখতে না-রাখতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। আজ ঘুম তার ধারেকাছেই ঘেঁষল না। শেয়ালের ডাক, পাচার রহস্যময় কণ্ঠস্বর, গাছের ডালে বাতাসের খটখট শব্দ, কুকুরের চিৎকার, যা শুনছে তাইতেই বারবার চমকে-চমকে উঠছে সে। কেবলই ধুকধুক করছে বুক, ওই বুঝি ভজহরি এল! আর এলেও কি তাকে চিনতে পারবে শিবেন? ভজহরি বরাবর স্কুল আর কলেজের স্পোর্টসে গো অ্যাজ ইউ লাইক-এ ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে এসেছে। ছদ্মবেশ পরতে অমন সিদ্ধহস্ত মানুষ আর আছে কিনা সন্দেহ। স্কুলে তাদের হেডমাস্টার ছিলেন উপেনবাবু, সাঙ্ঘাতিক রাশভারী আর রাগী লোক। তা সেবার হল কী, স্পোর্টসের শেষে যখন গো অ্যাজ ইউ লাইক হচ্ছে তখন ভারী একটা শোরগোল উঠল। দেখা গেল, আরও একজন উপেনবাবু আসরে ঢুকে পড়ে বেত হাতে ছাত্রদের সামলাচ্ছেন। সবাই হতভম্ভ, ভ্যাবাচ্যাকা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেক্রেটারি ভারী অবাক হয়ে বললেন, উপেনবাবু, আপনার কি জমজ ভাই আছে?
উপেনবাবু হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, না তো!
সেক্রেটারি অবিশ্বাসের গলায় বললেন, তা কী করে হয়? একইরকম হাইট, এক মুখ, এক চোখ, এক মাঝখানে। সিঁথি, এমনকী দুলকি চালের হাঁটা অবধি। ভাল করে ভেবে দেখুন, আপনার কোনও যমজ ভাই জন্মের পর মিসিং হয়েছিল কিনা। এরকম তো কতই হয়।
উপেনবাবু এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন যে, কথাই বলতে পারছিলেন না। যাই হোক, শেষ অবধি পণ্ডিতমশাই দ্বিতীয় উপেনের বাঁ-হাতের কবজির কাটা দাগটা দেখে চিনতে পেরে বলে উঠলেন, এ যে বদমাশ ভজহরি!
তখন হেডস্যার ভজহরির আস্পদ্দা দেখে তেড়ে গিয়ে এই মারেন কি সেই মারেন। তবে শেষ অবধি আশ্চর্য ছদ্মবেশের জন্য ভজহরি বিপুল প্রশংসা আর প্রাইজ পেয়েছিল। পরের বছর ভজহরি আরও সাংঘাতিক কাণ্ড করল। গো অ্যাজ ইউ লাইক যখন চলছে, তখন মাঠের মধ্যে একটি গোরু ঢুকে শান্তভাবে ঘাস খেয়ে যাচ্ছিল, কোনও দিকে ভূক্ষেপ নেই। যখন হেডস্যার রেজাল্ট ঘোষণা করতে উঠেছেন, তখন গরুটা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে পরিষ্কার মানুষের গলায় বলল, দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান। আরও একজন কম্পিটিটার আছে যে! সবাই হতভম্ভ। মানুষ যে এখন নিখুঁত গরু সাজতে পারে, এ যে সুদূর কল্পনাতেও আসে না। ফের প্রাইজ আর ভূয়সী প্রশংসা।
শিবেনের তাই ঘুম আসছে না। কারণ ভজহরি যে কোন রূপে দেখা দেবে তা কে জানে! এই শেয়ালটা হয়তো শেয়াল নয়, ভজহরি। ওই প্যাঁচাও হয়তো প্যাঁচা নয়, ভজহরি। যে বালিশে সে মাথা রেখে শুয়ে আছে, সেটাই যে ভজহরি নয় তার ঠিক কী?
নাঃ, আর শুয়ে থাকতে পারল না শিবেন। উঠে পড়ল। বালিশের পাশেই ফাঁইলবন্দি তার থিসিস। এটা খুব গুপ্ত জায়গায় লুকিয়ে না রাখলে ভজহরি এসে গাপ করবে বলেই তার স্থির বিশ্বাস।
গায়ে একটা আলোয়ান জড়িয়ে থিসিস বগলে নিয়ে সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরোল শিবেন। রাজবাড়ি তার চেনা এলাকা। সঙ্গে টর্চ থাকলেও সে তা জ্বালাল না। খুব নিঃশব্দে সে গাছপালার ভিতর দিয়ে আত্মগোপন করে রাজবাড়ির দিকে এগোতে লাগল।
আকাশে ক্ষয়টে একটু চাঁদ আছে বটে, কিন্তু কুয়াশার জন্য আলোটা বড়ই ঘোলাটে। তবে শিবেনের অসুবিধে নেই, রাজবাড়ির চৌহদ্দি তার চেনা জায়গা। সে গাছপালার ভিতর দিয়ে সাবধানে এগোচ্ছিল। বুকটা বড় ধুকপুক করছে। রাজবাড়ির ভিতরে মেলা পুরোনো আসবাবপত্র, আলমারি, দেরাজ, কুলুঙ্গি রয়েছে। গুপ্তকুঠুরি যদি না-ও পাওয়া যায়, তা হলে অন্তত লুকিয়ে রাখার মতো একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবেই।
বেশ এগোচ্ছিল শিবেন, কোথাও সন্দেহজনক কিছু দেখাও যাচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ কে যেন তার আলোয়ান ধরে একটা হ্যাচকা টান মারল। শিবেন সঙ্গে-সঙ্গে ফাঁইলখানা চেপে ধরে ককিয়ে উঠল, না ভাই ভজহরি, এরকম করাটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। এ আমার অনেক পরিশ্রমের ফসল…! বলে একটু বেকুব বনে গেল শিবেন। ভজহরি নয়, একটা গাছের ডালে তার চাঁদরটা আটকে গেছে। তবে গাছকেই বা বিশ্বাস কী? ওটাই যে ভজহরি নয় তাই বা কে জোর দিয়ে বলতে পারে?
চাঁদরটা ছাড়িয়ে নিয়ে শিবেন ফের এগোল। গাছপালার সারি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে রাজবাড়ি অবধি খানিকটা ফাঁকা জায়গা। শিবেন এদিকওদিক দেখে নিয়ে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে জায়গাটা পেরোতে যাচ্ছিল, ঠিক ওই সময় বাঁ-দিক থেকে কে যেন প্রায় নিঃশব্দে বিদ্যুতের গতিতে ছুটে এসে তার উপর লাফিয়ে পড়ল। শিবেন আত্মরক্ষার কোনও সুযোগই পেল না। বাপ রে! বলে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। কী হয়েছে তা বিভ্রান্ত মাথায় বুঝতেই পারল না সে। কয়েক সেকেন্ড বাদে সম্বিৎ পেয়ে সে দেখল তার বুকের উপর দুটো ভারী থাবা রেখে বিরাট একটা কেঁদো বাঘ তার মুখের উপর শ্বাস ফেলছে, আর জ্বলজ্বলে চোখে দেখছে তাকে।
শিবেন অত্যন্ত ব্যথিত গলায় বলল, ভজহরি, এ তোমার কেমন ব্যবহার ভাই? এভাবে লোককে হেনস্থা করা কি তোমার ঠিক হচ্ছে? যতই শত্রুতা থাক, আমরা তো ছেলেবেলায় বন্ধুই ছিলাম, সেকথা কী ভুলে গেলে? সজ্ঞানে তোমার কোনও ক্ষতি করেছি, বলো! হ্যাঁ, তোমার রবার লাগানো হলুদ পেনসিলটা চুরি করেছিলাম বটে, তবে সেটা করেছি তুমি আমার কাছ থেকে জোর করে যখেন ধন বইটা কেড়ে নিয়েছিলে বলে। ক্লাস সিক্সে তোমাকে একটা চিমটি দিয়েছিলাম, কারণ, ক্লাস ফাঁইভে তুমি আমাকে খেলার মাঠে ঘুসি মেরেছিলে। যাই হোক ভাই, পুরোনো শত্রুতা ভুলে যাও। বাঘের ছদ্মবেশে এসেছ বলে যে তোমাকে চিনতে পারব না, আমাকে তেমন বোকা পাওনি। থিসিসটা কেড়ে নিও না ভাই, আমার রক্ত-জল করা কাজ…।