যে আজ্ঞে!
মুখে যাই বলুক, পাঁচু নরহরি ঘোষ হওয়ার চেষ্টা করেনি। নরহরির নাম নিলে নাকি হাঁড়ি ফাটে। তবে কিছুদিন পাঁচু শ্রীপদ হওয়ার চেষ্টা করেছিল বটে। শ্রীপদ হল গাঁয়ের লিডার, সবাই তাকে ভারী খাতির করে।
বক্তৃতায় তার খুব নামডাক। শ্রীপদর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে লোকের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, মাথায় খুন চেপে যায়, আস্তিন গুটোতে থাকে। তার আবেগপূর্ণ ভাষণে লোকে ভেউ-ভেউ করে কাঁদে। দেশের অধঃপতন নিয়ে তার বক্তৃতার সময় সভায় সমবেত ছিঃ ছিঃ শোনা যায়। শ্রীপদর মুখ সর্বদাই গম্ভীর এবং চিন্তাকুল। এলেবেলে লোকের সঙ্গে সে কথাই কয় না। নিতান্ত মান্যগণ্যদের সঙ্গেও সে বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা কয়। সবাই বলে, শ্রীপদর নাকি খুব ব্যক্তিত্ব। পায়জামা আর গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা শ্রীপদ কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে যখন রাস্তায় বেরোয়, তখন সর্বদাই তার সঙ্গে পনেরো-বিশজন মোসাহেব হেঁ-হেঁ করতে করতে পিছু নেয়। দৃশ্যটা দেখলেই বুক ভরে যায়।
তবে অসুবিধেও আছে। পাঁচুর পায়জামা আর পাঞ্জাবি নেই, মোসাহেবও নেই। বক্তৃতাও সে কস্মিনকালে করেনি। তবে শ্রীপদ হওয়ার জন্য সে নির্জন মাঠে-ঘাটে গিয়ে একা একাই বক্তৃতা প্র্যাকটিস করতে লাগল। কাজ শক্ত নয়, কিছু কিছু কথা শোনাই ছিল।
তারপর পাশের গাঁ বৃন্দাবনঘাঁটিতে হাটবারে গিয়ে জনসমক্ষে তেলেভাজাওয়ালা বিরিঞ্চিপদর নড়বড়ে টুলটার উপর দাঁড়িয়ে ঠিক শ্রীপদর মতো গলা করে বন্ধুগণ… বলে বক্তৃতা শুরু করে দিল। বক্তৃতা হচ্ছে শুনে অনেকেই বিকিকিনি থামিয়ে ভিড়ও করে ফেলল বেশ। পাঁচু দেশের দুর্নীতি, দুর্গতি, অবনতি নিয়ে বেশ গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল বটে। কিন্তু সভায় একটু হাসি আর হুল্লোড়ও শোনা যাচ্ছিল। তার কারণ, পাঁচুর পরনে নীল রঙের হাফপ্যান্ট আর গায়ে খাকি রঙের সেই পুরোনো শার্টখানা।
তা প্রথমবার আধঘণ্টাটাক বলেছিল বটে পাঁচু। বক্তৃতার শেষটায় একটু গন্ডগোল হল। বিরিঞ্চিপদ তাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে নিজের টুলখানা নিয়ে যাওয়ায় ভারী অপ্রস্তুত হল পাঁচু। তবে লোকে যথারীতি হাততালি দিয়েছিল। আর আদর্শ বিদ্যাপীঠের বাংলার মাস্টারমশাই বলাইবাবু এসে বললেন, ওরে, বক্তিমে তো দিলি, কিন্তু তোর যে ব্যাকরণের জ্ঞানই নেই। একান্নটা ভুল শব্দ বলেছিস, ক্রিয়াপদ আর উচ্চারণের দোষ ধরলে তো অগুনতি!
তা দু-চারটে এরকম ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও তার প্রথম বক্তৃতাটা যে উতরে গেছে তা ভেবে পাঁচু বেশ খুশিই হল। এরকম কয়েকবার প্র্যাকটিস করলেই পাঁচুকে নিয়ে হইচই পড়ে যাবে। তখন আর পাঁচুকে পায় কে?
কিন্তু কপালটাই তার খারাপ। পরদিনই দুপুরবেলায় শ্রীপদর দুই চেলা মাধব আর কেলো এসে তাকে ধরল, অ্যাই, তুই নাকি বৃন্দাবনঘাঁটিতে হাটের মাঝখানে শ্রীপদদাকে ভেঙিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিস? আঁ, শ্রীপদদাকে নিয়ে ক্যারিকেচার! এত বড় সাহস!
তারপর সে কি মার রে বাপ! সারা শরীরে যেন একেবারে তবলালহরা বাজিয়ে গেল। মারের চোটে দিনসাতেক বিছানায় পড়ে থাকতে হল তাকে, তার ঘাড় থেকে শ্রীপদর ভূতও নেমে গিয়েছিল।
ইদানীং সে মন্মথ ভট্টাচার্য হওয়ার চেষ্টায় আছে। মন্মথবাবু অবশ্য বিদ্বান মানুষ। বিপিনচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলের হেডস্যার ছিলেন। সোজা সটান চেহারা, দিব্যি স্বাস্থ্য, গম্ভীর, কম কথার মানুষ, সবাই তাকে খুব শ্রদ্ধাভক্তি করে। গায়ে কোনও সভাসমিতি হলে মন্মথবাবু বাঁধা সভাপতি। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, কিংবা রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল-ক্ষুদিরাম-নেতাজিসন্ধ্যা, রক্তদান শিবির, শারদীয়া দুর্গোৎসবের শুভ উদ্বোধন কিংবা দ্বারোদঘাটনে মন্মথবাবুকে ছাড়া ভাবাই যায় না। তবে মন্মথবাবুর বক্তৃতাগুলো সাপটে ওঠা কঠিন। মরমী কবি রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি নজরুল, ক্ষুদিরামের আত্মদান, নেতাজির অন্তর্ধান, এসব বিষয়ে পাঁচুর তেমন ভাবটাব আসে না। তাই ও চেষ্টা সে করেনি। আপাতত সে শুধু সকাল আর বিকেলে মন্মথবাবুর প্রাতভ্রমণ আর সান্ধ্যভ্রমণটি নকল করার চেষ্টা করছে। মন্মথবাবুর ডান হাতে রুপোর বাঁধানো লাঠি, বাঁ-হাতে ধুতির কোচা, গায়ে গলাবন্ধ কোট, পায়ে মোজা আর পাম্পশু। ঘাড় উঁচু, পিঠ সোজা। হাঁটেন যেন গুলতি থেকে ছিটকে-যাওয়া গুডু লের মতো। এই এখন আছেন তো পরক্ষণেই ওই হোথা চলে গেছেন। কদিন ধরে মন্মথবাবুর পিছু নিয়ে হাঁটতে গিয়ে হেঁদিয়ে পড়েছে পাঁচু। তাও ভাগ্যিস, হাফপ্যান্টের কেঁচা হয় না, আর লাঠিও পাঁচু এখনও জোগাড় করে উঠতে পারেনি, পাম্পশুও তার নেই, তার পায়ে ছেঁড়া হাওয়াই চপ্পল।
এই সাতসকালে মন্মথবাবুর পিছু নিয়ে একটু দূর থেকে পাঁচু প্রায় দৌড়পায়ে আসছিল। বজরঙ্গবলীর মন্দির অবধি এসে আর পারল না। হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে লাগল। উদ্ধববাবু সেই অন্ধকার থাকতে সাতসকালে বাজার করতে বেরিয়েছেন। অত সকালে না বেরোলে তাঁর বাজারে পৌঁছতে বড্ড দেরি হয়ে যায়। এই সকালে বেরিয়েও বেলা বারোটার আগে প্রায় কোনওদিনই বাজারে পৌঁছতে পারেন না। বাজার যে তার বাড়ি থেকে অনেক দূর তাও নয়। বিষ্ণুপদ কানুনগো মেপে দেখেছেন উদ্ধববাবুর বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব মোট সাতশো সত্তর গজ। অর্থাৎ আধ মাইলের মতো। তবু যে ভোর সাড়েচারটেয় বেরিয়ে তিনি বেলা বারোটা নাগাদ বাজারে পৌঁছন, তার কারণ হল, রাস্তায় যত লোকের সঙ্গে দেখা হয়, দুপাশে যত বাড়ি আছে সকলেরই কুশল সংবাদ নেওয়া, নানা বিষয়ে দু-চারটে কথা কওয়া, কোন-কোন গাছে কেমন ফুল বা ফল হচ্ছে তার খতেন নেওয়া, নেড়ি কুকুর, হুলো বেড়াল, পোপাষা পাখিদের সম্পর্কেও খোঁজখবর করা তো আছেই। তা ছাড়া, কখনও হয়তো বিদ্যাচরণের সঙ্গে একহাত দাবা খেলে নিলেন, হাই স্কুলের মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে দেখে মাঠে নেমে একটু খাটান দিলেন, মহেশগয়লা দুধ দুইছে দেখে দাঁড়িয়ে খানিক দুধের ফেনার শুভ্রতা দেখে মুগ্ধ হলেন, আর এইসব করতে গিয়েই দেরিটা হয়ে যায়। তার বউ বলে-বলে হয়রান হয়ে এখন অন্য বন্দোবস্ত করেছেন। বাজারের ব্যাপারিরা মাছ আর আনাজ তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে পয়সা নিয়ে যায়। উদ্ধববাবু বাজার না করলেও বাড়ির চলে যায়। কিন্তু বাজার না করে উদ্ধববাবু মোটেই থাকতে পারেন না, তা হলে বড় আইঢাই হয়।