আমি তো বলেইছি, আমার ভূতপ্রেতে বিশ্বাস নেই, ভয়ও নেই।
তারপর ধরো, শীতকালটা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু গরম পড়লেই দেখবে, আনাচকানাচ থেকে বিষধর সব চক্করওয়ালা লতানে জিনিস বেরিয়ে আসবে। গোখরো, চন্দ্রবোড়া, কালাচ, কেউটে, কী নেই সেখানে। চারধারে কিলবিল করে বেড়াবে।
কই, আমি তো তেমন সাপখোপ দেখতে পাইনি কখনও।
আহা, তার কি আর সময় গেছে! গতবার দ্যাখোনি তো কী হল! এবারেই হয়তো দেখবে। তাই বলছিলাম, কাজ কী তোমার ওই বিপদের মধ্যে থেকে?
শিবেন হেসে বলল, বিপদ ঘটলে তখন দেখা যাবে।
হরগোবিন্দ ঘোষাল নিজের বাড়ির মোড়টায় এসে বলল, চলি হে ভায়া, যা বললুম একটু ভেবে দেখো, আখেরে তোমার লাভই হবে।
শিবেন জবাব না দিয়ে হাঁটা ধরল।
জমিদার বাড়িটা বিশাল বাগান দিয়ে ঘেরা। বাগানের পাঁচিল অনেক জায়গায় ভেঙে পড়েছে। বাগানে আগাছাও বিস্তর।
ফটক থেকে অনেকটা ভিতর দিকে, অন্ধকারে পুরোনো বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদ না হলেও বাড়িখানা পেল্লায় বড়। এখন আর কেউ এখানে থাকে না। বুড়ো শ্যামাচরণই একমাত্র পড়ে আছে, যাওয়ার জায়গা নেই বলে।
ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকে বাঁধারে পুকুরের পুব ধারে ব্যারাকের মতো একটা লম্বা দালানই হচ্ছে খাজাঞ্চিখানা। শিবেন টর্চ জ্বেলে দেখল, তার ঘরের সামনে বারান্দায় শ্যামাচরণ একখানা চাঁদরে মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে আছে।
এ কী শ্যামাদা, তুমি এখানে বসে আছ যে!
আর বোলো না, তোমার ঘরে যে আজ সন্ধেরাতে চোর ঢুকেছিল!
শিবেন চমকে উঠে বলল, চোর! বলো কী!
রোজ সন্ধেবেলা আমি একটু হরিনাম শুনতে বিষ্ণুমন্দিরে যাই, সবাই জানে। আজ একটু শরীরটা রসস্থ হওয়ায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ঠাকুর দালানে পিদিম জ্বেলে দিয়ে ঘরে ফেরার সময় হঠাৎ দেখি দু-দুটো লোক তোমার ঘরের দরজার তালা খোলার চেষ্টা করছে। হাঁক করতেই অবশ্য দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল। কিন্তু লক্ষণটা ভালো ঠেকল না। ময়নাগড়ের সব চোর আমার চেনা। আবছা অন্ধকারে দেখা বটে, কিন্তু এরা এখানকার লোক নয়। এ তল্লাটের চোর এ বাড়িতে হানা দেবে না। বলি, দামি জিনিস-টিনিস কিছু রেখেছ নাকি ঘরে?
শিবেন আমতা-আমতা করে বলে, না, না, দামি জিনিস আর কী থাকবে আমার ঘরে! শুধু বইপত্র আর খাতা কলম।
তালাটা চোরেরা খুলে ফেলেছে, তবে ঘরে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। আমি সেই থেকে বসে তোমার ঘর পাহারা দিচ্ছি। আগে ঘরে ঢুকে হ্যারিকেনটা জ্বেলে দ্যাখো তো কিছু খোয়া গেছে কিনা।
শিবেন দরজার তালাটা পরীক্ষা করে দেখল, সেটা কেউ হ্যাক স দিয়ে কেটে ফেলেছে। মুখটা শুকিয়ে গেল তার। ঘরে ঢুকে কাঁপা হাতে হ্যারিকেন জ্বেলে দেখল, ঘরের জিনিস সব ঠিকঠাকই আছে।
শ্যামাচরণ পিছু পিছু ঘরে ঢুকে বলল, ভালো করে দেখেছ?
কিছু চুরি যায়নি বলেই মনে হচ্ছে।
বিপদ কী জানেনা, সন্ধেবেলাটায় তুমি পড়াতে যাও, আমি যাই হরিকীর্তনে। বাড়িটা ফাঁকা থাকে। চোর যদি আবার আসে, তবে ঠেকাবে কে?
শিবেন বিপন্ন গলায় বলে, তাই তো ভাবছি।
তুমি মাস্টার মানুষ, ছেলে পড়িয়ে খাও, শেঠিয়া লোক তো নও। তবে তোমার উপর চোরের নজর পড়ল কেন বলো তো! রাত-বিরেতে যদি দলবল জুটিয়ে আসে তখন
তো আরও বিপদ। আমি বুড়ো মানুষ, আর তুমি জোয়ান হলেও পালোয়ান তো নও। ঠেকাবে কী করে?
শিবেন দুশ্চিন্তায় পড়ে বলল, হুঁ।
শ্যামাচরণ দুঃখের গলায় বলল, ময়নাগড় বড় শান্তির জায়গা ছিল হে। কিন্তু দিনগুলো পালটে যাচ্ছে। লোক দুটো দেখতে কেমন বলতে পার?
অন্ধকারে কী করে বুঝব? দুটো কালো কালো মানুষের আকার দেখেছি। তার বেশি কিছু বলতে পারব না।
আচ্ছা শ্যামাদা, রাজবাড়িতে গুপ্তকুঠুরি কিছু আছে? শ্যামাচরণ সন্দিহান হয়ে বলল, কেন বলো তো!
ভাবছিলাম, কিছু কাগজপত্র যদি লুকিয়ে রাখা যায়? শ্যামাচরণ অবাক হয়ে বলে, শোনো কথা? বলি কাগজপত্র কি লুকোনোর জিনিস? চোর কি কাগজপত্র চুরি করতে আসবে? বলি, সোনাদানা কিছু আছে?
শিবেন মিনমিন করে বলে, না, সোনাদানা কোথা থেকে। আসবে?
ভালো করে ভেবে দ্যাখ দিকিনি। চোরে কি আর এমনি হানা দেয়? কিছু একটা গন্ধ পেয়েই এসেছিল। সত্তর বছর আগে এ-বাড়িতে একবার ডাকাত পড়েছিল, মনে আছে। তখন আমি ছোট। জমিদারের পাইকরা খুব লড়েছিল ডাকাতের সঙ্গে। তবে যে-সে ডাকাত তো নয়, কেলোডাকাত বলে কথা! পাইকরা তাদের লাঠি সড়কির সামনে দাঁড়াতে পারল না। সব লুটেপুটে নিয়ে গেল। তার পর থেকে আজ অবধি আর এ-বাড়িতে চোর-ডাকাত আসেনি। আর আসবেই বা কেন! বাবুদের অবস্থা পড়ে গেল। তারপর তো সব যে যার পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলল। থাকার মধ্যে এই আমি পড়ে আছি। যে বাড়ির এত জাঁকজমক ছিল, তাতে এখন ইঁদুর, বাদুর, চামচিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পড়ে আছে শুধু কয়েকখানা ভাঙা খাট-পালঙ্ক। তা এত বছর বাদে ফের চোরের আনাগোনা কেন শুরু হল সেটা ভাববার কথা।
শিবেন বিনয়ের সঙ্গেই বলল, চোরের নেওয়ার মতো তো কিছু নেই শ্যামাদা। তবে টাকাপয়সা বা সোনাদানা না থাকলেও আমার কিছু রিসার্চ-ওয়ার্ক আছে। সেগুলো বেহাত হলে আমার ক্ষতি।
দূর! দূর! তুমিও যেমন! কাগজপত্র নিতে আসবে কোন আহাম্মক? তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।
শ্যামাচরণ কথাটা উড়িয়ে দিলেও শিবেনের দুশ্চিন্তা গেল। আসল কথা হল, কলেজে পড়ার সময় থেকেই ভজহরি নামে একটা ছেলের সঙ্গে তার রেষারেষি। ভজহরি যেমন শিবেনকে দেখতে পারে না, শিবেনও তেমনি ভজহরিকে। ভজহরি আড়ালে সবাইকে বলে বেড়ায়, শিবেন! ও তো টুকে পাশ করেছে। অথচ শিবেন ভালোই জানে, টুকে পাশ করেছে ভজহরিই, এবং টুকেছে শিবেনেরই খাতা থেকে। যাই হোক, রেষারেষি করেই তারা এম এসসি অবধি পাশ করেছে। দুজনেই ডক্টরেটের জন্য রিসার্চ করছে। কে কার আগে থিসিস জমা দেবে তাই নিয়ে চলছে মর্যাদার লড়াই এবং স্নায়ুযুদ্ধ। বাইরের লোক বুঝতেও পারবে না, এটা কী সাঙ্ঘাতিক প্রেস্টিজের ব্যাপার। শিবেনের ঘোর সন্দেহ, ভজহরি যেনতেন প্রকারে তার রিসার্চ ভণ্ডুল করার চেষ্টা করবে। শিবেন যে ভজহরিকে ভয় পায় তার কারণ হল, ভজহরি অনেক তুকতাক জানে। কলেজে পড়ার সময়ই সে বেশ নামকরা একজন ম্যাজিশিয়ান ছিল। তা ছাড়া কুংফু, ক্যারাটে এসবও শিখেছিল। কাজেই ময়নাগড়ে যে রহস্যময় আগন্তুকের কথা শোনা যাচ্ছে, তা যে ভজহরিই, তাতে সন্দেহ নেই। ভজহরি ছাড়া আর কে শিবেনের ঘরে হানা দেবে?