আমি যতদূর জানি, বলাই বার্ষিক পরীক্ষায় অঙ্কে তেইশ পেয়েছিল।
আহা, খাতায়-কলমে তেইশ হলেও, যে অঙ্কগুলো ঘণ্টা পড়ে যাওয়ায় করতে পারেনি, সেগুলো ধরলে আটত্রিশ কেন, একটু বেশিই দাঁড়ায়। স্কুলের পরীক্ষায় আর কটা ছেলের ঠিকঠাক অ্যাসেমেন্ট হয় বলো!
তা অবিশ্যি ঠিক।
বলে শিবেন ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
হরগোবিন্দ ঘোষাল গলাটা একটু নামিয়ে বলল, বাপু হে, তুমি যে কেন জমিদারবাড়ির খাজাঞ্চিখানায় পড়ে আছ তা বুঝি না। ও হল হানাবাড়ি, আজ বিশ-পঁচিশ বছর হল ও বাড়িতে কেউ থাকে না। শুধু বুড়ো শ্যামাচরণের তিন কুলে কউ নেই বলে নাচার হয়ে পড়ে আছে। সে অবিশ্যি ওই বাড়িতেই সারাজীবন কাটিয়েছে বলে মায়ার টানও হয়তো একটু আছে। কিন্তু কাজ কী তোমার ওই ভুতুড়ে বাড়িতে পড়ে থেকে? বরং আমার বাড়িতে চলে এসো। বাইরের বাগানের দিকটায় দুই নাতি কানাই আর বলাইয়ের জন্য পড়ার ঘর করেছি। দিব্যি বড়সড় ঘর। তার একধারে চৌকি পেতে দিব্যি থাকবে। দু-বেলা আমাদের সঙ্গেই দুটি খেও। কোনও অসুবিধে হবে না। ওই সঙ্গে কানাই, বলাইকে ঘমেমেজে একটু মানুষ করে দাও।
শিবেন হেসে বলে, আজ্ঞে, আপনার প্রস্তাব তো খুবই ভাল! তবে কিনা আমার খাজাঞ্চিখানায় থাকতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। ভূতের ভয় আমার নেই। জায়গাটা নিরিবিলি বলে আমার লেখাপড়ারও একটু সুবিধে হয়।
হরগোবিন্দ ভারী অবাক হয়ে বলল, লেখাপড়া? মাস্টার হয়ে আবার লেখাপড়া কিসের? বলি, লেখাপড়া শেষ করেই তো লোকে মাস্টার হয়। তারপরও কেউ লেখাপড়া করে নাকি? তা হলে আর জীবনে সুখ কী রইল বলো?
কেন, লেখাপড়ার মধ্যে কি সুখ নেই?
দূর দূর! কী যে বলো ভায়া! লেখাপড়ার মধ্যে আবার সুখের কি দেখলে? শুকনো বই খুলে বসে থাকার কোনও মানে হয়? সময় নষ্ট, আয়ু ক্ষয়, শিরঃপীড়া, চোখে ছানি আসবে, আমার বাড়িতে গেলে দেখবে নাতিউতিদের পড়ার বই ছাড়া বই বলতে আছে শুধু একখানা পঞ্জিকা, একখানা লক্ষ্মী আর একখানা সত্যনারায়ণের পাঁচালি আর একখানা কাশীদাসী মহাভারত। আর বইপত্রের নামগন্ধও নেই। বই পড়া মানে তো সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করা ছাড়া কিছু নয়। এই আমাকেই দ্যাখো না কেন, ইশকুলের গণ্ডিটা ডিঙিয়েই ও পাট চুকিয়ে দিয়েছি। সকালে উঠে একটু হরিনাম নিয়েই গো-সেবায় লেগে পড়ি। তারপর চাট্টি মুড়িটুড়ি খেয়ে বাজারে যাই। দুপুরে চাট্টি খেয়েই লম্বা দিবানিদ্রা। বিকেলে একটু বাগানের কাজ, তারপর আড্ডা। এই এখন বাড়িতে ফিরে খেয়েদেয়ে লেপের তলায় ঢুকে যাব। একঘুমে ভোর, দিব্যি আছি।
শিবেন মাথা নেড়ে বলে, তাই বটে, তবে আমার একটু লেখাপড়ার বাই আছে।
হরগোবিন্দ কৌতূহলী হয়ে বলল, তা কী বই পড়ো তুমি? নাটক, নভেল, নাকি গুপ্তবিদ্যাটিদ্যা কিছু?
আজ্ঞে না। আমি হায়ার ম্যাথমেটিক্স আর বিজ্ঞানের বই পড়ি।
ওরে বাবা! শুনেছি অঙ্কের বই নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে হাঁফানি আর শ্লেষ্মর দোষ হয় আর বিজ্ঞান নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করাও নাকি ভালো কথা নয়। ওতে লোকে নাস্তিক হয়। আর তাতে ঠাকুর-দেবতারা ভারী কুপিত হয়ে ওঠেন।
শিবেন শান্ত গলায় বলে, বইটই না পড়লে জ্ঞান হবে কী করে? জ্ঞানই তো মানুষের মস্ত সম্পদ।
ঘোষাল একটু ভাবিত হয়ে বলল, সেকথাও মিথ্যে নয়। জ্ঞান খুব দামি জিনিসই হবে। তবে কি জানো বাপু, বেশি জ্ঞানই কি ভালো? এই যে আমাদের মন্মথবাবু বিদ্যে একেবারে গুলে খেয়ে বসে আছেন। তা তার কি তাতে শান্তি আছে? পেটে বিদ্যে আছে বলে রাজ্যের লোক তার কাছে দরখাস্ত লেখাতে আসে। নানা জটিল জিনিস সরল করে বুঝতে হাজির হয়। একদিন তো শুনলুম, কোথাকার একটা উটকো লোক এসে তেঁতুলবিচিকে কেন কাইবিচি বলা হয় তাই নিয়ে সকাল থেকে দুপুর অবধি তর্ক করে গেল।
শিবেন হতাশ হয়ে বলল, আপনি দেখছি লেখাপড়া বিশেষ পছন্দ করেন না! তা হলে আর নাতিকে বিদ্বান করতে চাইছেন কেন?
হরগোবিন্দ বলল, আহা, বিদ্যে কি আর খারাপ জিনিস? তা তো আর বলিনি হে বাপু। বলছি কোনও জিনিসের বাড়াবাড়ি কি ভালো? পড়ার বয়সে না হয় একটু পড়লে টড়লে, কিন্তু তারপর পাশটাস করে চাকরিতে ঢুকে গেলে আর ওসবের দরকারটা কী? তা, সে কথা থাক। তুমি তা হলে ওই খাজাঞ্চিখানাতেই থাকবে বলে মনস্থ করেছ তো!
আজ্ঞে হ্যাঁ, জায়গাটা ভারী ভালো। যেমন বড় ঘর, তেমনই ভারী নিরিবিলি।
তা বটে, তবে কিনা ওই খাজাঞ্চিখানাতেই নগেন পোদ্দার গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছিল।
নগেন পোদ্দার কে বলুন তো?
সে অবশ্য চল্লিশ বছর আগেকার কথা। খাজাঞ্চিখানায় খাতা লিখত নগেন পোদ্দার। জমিদার প্রসন্ন রায়ের আমল। নগেন পোদ্দারের মতো অমন হাড়কেপ্পন তোক আর ভূভারতে নেই। চেহারাখানাও হাড়গিলে শকুনের মতো। সর্বদা চারিদিকে শ্যেণদৃষ্টি। এক পয়সা ফাদার-মাদার। কোথাও কাঙালিভোজন হচ্ছে খবর পেলেই সেখানে গিয়ে পেটপুরে খেয়ে আসত। খেয়ে না-খেয়ে এক কলসি টাকা জমিয়েছিল। একদিন সেই টাকা কলসি সমেত চুরি যায়। টাকার শোকে নগেন প্রথমে পাগল হয়ে গেল, তারপর পাথর। চুপচাপ বসে বিড়বিড় করত। তারপর এক রাতে ফাঁসিতে ঝুলে পড়ল। তার প্রেতাত্মা সেই টাকার কলসি খুঁজে বেড়াত, অনেকেই দেখেছে। তাই বলছিলাম ভায়া, খাজাঞ্চিখানা জায়গাটা এমনিতে মন্দ নয় বটে, তবে কিনা–