এটাও কি সায়েন্সে বলেছে?
তবে? নরহরির কাছে পুঁথিখানা আছে, খুব গুপ্ত পুঁথি। সাহেবদেরই বই, তবে বাংলায় লেখা। খালাসপুরের হাটে যুধিষ্ঠির দাস নামে যে লোকটা বইপত্র বেচতে আসে, তার কাছ থেকে মেলা ঝোলাঝুলি করে কেনা, দু-টাকার বই দশ টাকায় রফা হয়েছে।
শিবেনের ফের দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সে মিনমিন করে বলল, সাহেবরা বাংলা বই লিখতে যাবে কেন সেটাই বুঝতে পারছি না।
উদ্ধববাবু গলাটা আরও খাটো করে বললেন, আহা, এটা না বোঝার কী আছে হে বাপু! ইংরিজিতে লিখলে অন্য সব সাহেবরা জেনে যাবে যে! বাংলায় লিখলে জিনিসটা লেখাও হয়ে রইল, গোপনও থাকল। বড়-বড় দোকানে ও বই পাবে না, গাঁয়েগঞ্জে খুব গোপনে দু-চারজন বিক্রি করে।
একটু আগে গোবিন্দর হাই তোলা দেখে শিবেনেরও হাই উঠেছিল। ঘুম-ঘুম ভাবটাও বেশ চেপে ধরেছিল তাকে। এখন এসব বৃত্তান্ত শুনে ঘুম পালিয়েছে বটে, কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস পেয়ে বসেছে শিবেনকে। দীর্ঘশ্বাসকে চেপেচুপে ছোট করাতে কিছুতেই পেরে উঠছে না সে। মাথাটাও একটু-একটু ঘুরছে। সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, এবার তা হলে আসি উদ্ধববাবু?
আহা, আটটা দশ মিনিট বাজছে যে! এ সময়ে বেরোতে আছে?
অবাক হয়ে শিবেন বলে, আটটা দশ মিনিটে বেরোলে কী হয়?
তুমি যে জমিদারবাড়ির খাজাঞ্চিখানায় থাকো। ওর কাছেই তো পদ্মঝিল। এ সময়ে কলসি-কানাই ঝিল থেকে উঠে তার বউ-বাচ্চাকে দেখতে যায় যে।
শিবেন হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, কলসি-কানাইটা আবার কে?
উদ্ধববাবু খুব বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, তাও জানো তুমি! কলসি-কানাই সম্পর্কে বেশি না বলাই ভালো। নতুন এসেছ এই গাঁয়ে, ভয়টয় পাবে। তবে মোদ্দা কথা হল, রাত আটটা থেকে নটার মধ্যে পদ্মঝিলের দিকটায় না যাওয়াই ভালো, বলা তো যায় না।
শিবেন একটু হেসে বলল, ভূত নাকি? আপনাকে তো বলেইছি, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, ভূতটুত মানি না।
ওরে বাপু, ভূতেরও বিজ্ঞান আছে, নাকি? নইলে ভৌতবিজ্ঞান হল কী করে?
আজ্ঞে, ভৌতবিজ্ঞান অন্য জিনিস। সেটা ভৌতিক বিজ্ঞান নয়।
ওপর-ওপর বোঝা যায় না হে! তলিয়ে পড়লে দেখবে, ওর মধ্যেই ঠারেঠারে ভূতের বৃত্তান্ত গোঁজা আছে।
আজ্ঞে সেটাকেই বোধহয় গোঁজামিল বলে। বিজ্ঞানেই তো বাপু পঞ্চভূতের কথা আছে। শিবেন বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বলল, তা বটে! তবে সেই ভূত কিন্তু প্রেতাত্মা নয়।
মিলেমিশে থাকে হে, টক করে বোঝা যায় না। একটোপ্লাজম কী জিনিস জানো?
আজ্ঞে না।
ভূত হল ওই জিনিস দিয়ে তৈরি, যদুর শুনেছি, এক চামচ ক্ষিতি, দেড়চামচ অপ, এক চিমটি তেজ, এক খাবলা মরুৎ, আর খানিকটা ব্যোম মিশিয়ে তার মধ্যে একটু ফসফরাস ঘষে দিলেই একটোপ্লাজম তৈরি।
শিবেন উঠে হাতজোড় করে বলল, বড্ড রাত হয়ে যাচ্ছে উদ্ধববাবু, আজ আমি আসি গিয়ে। শরীরটা একটু কাহিল লাগছে।
যাবে! তা ঝিলের ধারের রাস্তায় না গিয়ে বাবুপাড়ার রাস্তা দিয়ে যেও।
যে আজ্ঞে! বলে শিবেন বেরিয়ে পড়ল।
সন্ধের পর ময়নাগড় ভারী ভয়ের জায়গা, কারণ শীতকালের দিকটায় আশেপাশে চিতাবাঘের খুব উৎপাত। তা ছাড়া উত্তরের জঙ্গলে যেসব ভালুকের কথা শোনা যায়, তারাও বিশেষ ভালমানুষ নয়। বাগে পেলে লম্বা নখ আর দাঁতে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। মাঝে-মাঝে হাতির পালও বোরোয়। নেকড়ে বাঘ বা বুনো কুকুরের দৌরাত্মের কথাও খুব শোনা যায়। কাজেই সন্ধের পর ময়নাগড় ভারী শুনশান জায়গা। পথে লোকের চলাচল নেই বললেই হয়। সন্ধে সোওয়া আটটায় যেন নিশুতি রাত নেমে এসেছে।
প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও শিবেনের মাথাটা আজ গরম। ভূতপ্রেতে সে বিশ্বাসী নয় ঠিকই, কিন্তু যে, বিপদের আঁচ সে পেয়েছে, তাতেই বুক ধকধক করছে, মনে উদ্বেগ, রাস্তায় পা দিয়ে সে অত্যন্ত দ্রুতবেগে হাঁটছিল। গাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তার নগেন সরখেলের চেম্বারে গাঁয়ের প্রবীণদের একটা সান্ধ্য জমায়েত হয়। বাঁদুরে টুপি, সোয়েটার, চাঁদরে জাম্বুবান হয়ে সব বসে আছে। আর ভিতর থেকে হরগোবিন্দ ঘোষাল মুখ বাড়িয়ে হেঁকে বলল, কে হে, শিবেন নাকি?
যে আজ্ঞে।
দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। কখন থেকে বাড়ি যাব বলে একজন সঙ্গী খুঁজছি, তা ওইখানে যাওয়ার কেউ নেই আজ। বুড়োমানুষ, তার উপর পাঁচু খবর দিয়ে গেল বাঁশতলার কাছে, রামহরির বাড়ি থেকে তার বাছুরটাকে আজ সন্ধেবেলায় চিতাবাঘে নিয়ে গেছে।
বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হল শিবেনকে। যদিও মনটা উচাটন, কিন্তু গাঁয়ে থাকতে গেলে সকলের সঙ্গে সমঝোতা থাকা ভালো।
হরগোবিন্দ ঘোষাল সঙ্গ ধরে বলল, ওই উদ্ধবের নাতি গোবিন্দর পিছনে বাপু তুমি বৃথাই আয়ুক্ষয় করছ। গোবিন্দর ঘুম কেউ ভাঙাতে পারবে না। তার চেয়ে তুমি বরং আমার নাতি বলাইকে পড়াও। গত বার্ষিক পরীক্ষাতেও অল্পের জন্য অঙ্কের লেটার মার্ক ফসকে গেছে। তুমি হাতে নিলে একশোতে একশো পাবে।
বলাই অঙ্কে কত পেয়েছিল?
ওই তো বললুম, লেটার মার্কটা পেয়েও পেল না। সরল অঙ্কটা সব ঠিকঠাক করেও উত্তরের জায়গায় শূন্যের বদলে নাকি এক লিখেছিল। আসলে লিখেছিল শূন্যই, কিন্তু তাড়াহুড়োয় কলমের খোঁচা লেগে শূন্যের মাথায় একটা টিকি বসে যায়। তাইতেই দশ-দশটা নম্বর পিছলে গেল। চৌবাচ্চার অঙ্কেও তাই, সব ঠিকঠাক করে শেষ লাইনে কী একটা গণ্ডগোল, গেল দশটা নম্বর। কপালের ফেরে অ্যালজেব্রাতেও এক্স লিখল, মাস্টারমশাই সেটা ওয়াই ভেবে দিলেন ঘ্যাচাং করে নম্বর কেটে। কপালের ফের রে ভাই! জ্যামিতির কথা শুনবে? যতবার ত্রিভুজ আঁকতে যায়, পেনসিলের শিস যায় ভেঙে। ফের পেনসিল কেটে শিস বার করতে করতে ঘণ্টা পড়ে গেল। যাই হোক, লেটার মার্ক ফসকালেও নম্বর খুব একটা খারাপ নয়। আটত্রিশ, একটু ধরিয়ে মকশো করে দিলে, ওই আটত্রিশ অষ্টাশি হতে লহমাও লাগবে না।