শিবেন থমতম খেয়ে কী বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু বলল, যে আজ্ঞে!
উদ্ধববাবু চোখ গোল-গোল করে বললেন, বললে বিশ্বাস হবে না ভায়া, জলজ্যান্ত দিনেদুপুরে ভূত এসে হাজির হয়েছে। কী বিপজ্জনক পরিস্থিতি বলল তো! এরকম চলতে থাকলে তো ময়নাগড় একেবারে ভূতের বৃন্দাবন হয়ে উঠবে!
শিবেন একটু উদ্বেগের গলায় বলল, তাকে আপনি কোথায় দেখেছেন?
সকালবেলায় বাজারে যাওয়ার পথে, তেঁতুলতলায়। কী বলব ভায়া, তার সঙ্গে যে কিছুক্ষণ খোশগল্পও করেছি। ভূত বলে ঘুণাক্ষরেও বোঝা যায়নি। রঙ্গ-রসিকতাও করছিল। দিব্যি সুন্দরপানা লম্বা-চওড়া চেহারা, তার ওপর দিনমানের আলোয় দেখা। ভূত বলে মনে হওয়ার কারণও ছিল না। কথা কইতে কইতে হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়াতেই বুঝলাম যে, সে ভূত।
শিবেন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, গোবিন্দ বলছিল, লোকটা নাকি ম্যাজিশিয়ান!
তা বলছিল বটে! কিন্তু তার কোন কথাটা সত্যি, আর কোন কথাটা মিথ্যে, তা কে বলবে!
ম্যাজিশিয়ানরা অনেক কৌশল জানে। ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া তার একটা কৌশলও হতে পারে।
আহা, ওসব স্টেজে হয়। কিন্তু দিনেদুপুরে একটা লোকের হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!
উন্নততর প্রযুক্তি আর কৌশলে সবই সম্ভব।
উদ্ধববাবু একটা চেয়ার টেনে শিবেনের পাশে বসে গলা নামিয়ে বললেন, বাপু হে, তুমি তো সায়েন্সের লোক, অনেক জানোটানো, তা হলে কি বলতে চাও, লোকটা আমার চোখে ধুলো দিয়েছে?
শিবেন একটু হেসে বলল, সেটাই সম্ভব। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। ভূতপ্রেত মানি না। আপনি যাকে দেখেছেন তাকে ভূত বলে মনে হচ্ছে না। তবে সে কোনওভাবে একটা অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরি করেছিল। উন্নততর প্রযুক্তির সাহায্যে সেটা সম্ভব হতেও পারে।
তা হলে কি লোকটা আমাকে ম্যাজিক দেখিয়ে বোকা বানাল?
আমার অন্তত তাই মনে হচ্ছে।
দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। ছোঁকরা আমাকে কিছু কথা বলেছিল।
শিবেন হঠাৎ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বলল, কী কথা?
বলেছিল, তাকে নাকি কিছু লোক খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে সেইজন্য গা-ঢাকা দিয়ে থাকার জায়গার সন্ধানে ময়নাগড়ে এসে হাজির হয়েছে। যারা খুঁজছে জিগ্যেস করায় সে পুলিশ, মিলিটারি আর ইন্টারপোলেরও নাম করেছিল। এখন ভাবছি, ভূত হলে পুলিশটুলিসের তো তাকে খোঁজার কথা নয়।
শিবেন একটু নিভে গিয়ে বলে, যে আজ্ঞে!
তোমার কি মনে হয় বলো তো ভায়া, লোকটা ভূত
উঁচুদরের ধাপ্পাবাজ?
শিবেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ভূত নয় বলেই জানি। তবে ধাপ্পাবাজ কিনা তা জানি না।
আমি বুড়োমানুষ, চোখের ভুল হলেও হতে পারে। কিন্তু পাঁচু তো আর বুড়ো নয়। সেও তো দেখেছে।
পাঁচু কে বলুন তো?
সে তুমি চিনবে না। গাঁয়ের ছেলে, নিষ্কর্মা।
বিশ্বাসবাড়ির বোকাসোকা ছেলেটা নাকি?
হ্যাঁ, সে-ই।
পাঁচু মাঝে-মাঝে আমার কাছে আসে। তাকে চিনি। আপনারা দুজন ছাড়া আর কেউ দেখেছে লোকটাকে?
মাথা নেড়ে উদ্ধববাবু বললেন, দেখলেও কেউ কবুল করেনি। তবে সে যখন এখানে থানা গেড়েছে তখন অনেকেই দেখবে।
শিবেন খুব চিন্তিত হয়ে বলল, হুঁ।
তা হলে ভয়ের কিছু নেই বলছ তো! সায়েন্সের লোকেরা ভরসা দিলে আমরা একটু জোর পাই। এই তো সেদিন নরহরি ঘোষ বলল, সায়েন্সে নাকি বলেছে, শনিপুজোর সিন্নি খেলে নাকি ম্যালেরিয়া সেরে যায়। কারণ, তাতেই শনির তেজস্ক্রিয়তা এসে ঢুকে এমন ভজঘট্ট পাকিয়ে তোলে যে, ম্যালেরিয়া পালানোর পথ পায় না।
বলেছে বুঝি?
নরহরি সায়েন্সের মেলা খবরটবর রাখে। এই গাঁয়ে বিজ্ঞানের সলতেটা ও-ই জ্বালিয়ে রেখেছে কিনা! অ্যাটম বোমা জিনিসটা কী তা নরহরিই তো একদিন জলের মতো বুঝিয়ে দিল আমাদের।
বটে!
তবে আর বলছি কী। বলল, অ্যাটম নাকি পোস্তদানার চেয়ে ছোটও জিনিস। তবে ভারী তেজি, লম্বা মতো একটা নলের মধ্যে ভরে খুব ঠেসে দিতে হয়, তারপর এরোপ্লেনে উঠে পলতেয় আগুন দিয়ে ফেলে দিতে হয়। যখন ফাটে তখন নাকি দেখবার মতো জিনিস। আমাদের কাশেমের চরে নাকি অ্যাটমের খনি আছে। বস্তা-বস্তা অ্যাটম চালান যাচ্ছে বিদেশে। অ্যাটম বেচেই তো কাশেম লাল হয়ে গেল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবেন বলল, নরহরিবাবু খুবই জ্ঞানী লোক দেখছি।
এমনিতে নরহরি লোক সুবিধের নয়, বুঝলে। ভারী ঝগড়ুটে, বিশ্বনিন্দুক, হাড়কেপ্পন। কিন্তু বিজ্ঞানটা জানে ভাল। ইশকুলের সায়েন্সের মাস্টারমশাই বিষ্টুবাবু পর্যন্ত ওর সামনে দাঁড়াতে পারেন না। ইস্কুলে সেদিন মাধ্যাকর্ষণ বোঝাতে গিয়ে নিউটনের সেই গাছ থেকে আপেল পড়ার বৃত্তান্ত বলছিলেন বিষ্টুবাবু। তা নরহরি সেদিন চণ্ডীমণ্ডপে বসে বলছিল, বিষ্টুবাবু অর্ধেকটা জানেন, বাকি অর্ধেকটা জানেন না। আপেলটা পড়েছিল ঠিকই, তবে সেটা পড়েছিল নিউটনের মাথায়। বিলেতের আপেল, সাইজেও এক-একটা তালের মতো। মাথায় পড়াতে নিউটনের ঘিলু চলকে গিয়ে দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়, আর তাইতেই মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করে ফেলেন। তবে নরহরি এ-কথাও বলেছে, মাধ্যাকর্ষণের আসল ব্যাপারটা খুব গুহ্য কথা, এখনও বিজ্ঞানীরা সব চেপেচুপে রেখেছেন। কয়েক বছর পর তা প্রকাশ পাবে।
শিবেন অবাক হয়ে বলে, সে কথাটা কী?
উদ্ধববাবু গলা খাটো করে বললেন, আগে নাকি মাধ্যাকর্ষণ বলে কিছু ছিল না, তখন মানুষ, গরু, কুকুর, ছাগল মায় গাছপালা অবধি গ্যাসবেলুনের মতো ভেসে ভেসে বেড়াত, তারপর উঁচুতে উঠতে-উঠতে স্বর্গে গিয়ে ঠেকত। তাইতে স্বর্গের লোকেরা ভারী জ্বালাতন হয়ে উঠল। স্বর্গে গাদাগুচ্ছের মানুষ, গোরু, ছাগল ঢুকে পড়ায় বিশৃঙ্খল অবস্থা। ওদিকে পৃথিবী ফাঁকা পড়ে আছে। সৃষ্টি রসাতলে যাচ্ছে। তখন নাকি সৃষ্টি বাঁচাতে ব্রহ্মা একটা রাক্ষুসে চুম্বক মাটির নীচে পেতে দিলেন। ব্যাস, সেই থেকে সব আমরা আটকে আছি।