বলেন কী ওস্তাদ! অমন তেজি দাড়ি দেখে আমি তো ভাবলাম, মস্ত বড় সাধক।
সাধক বটে, তবে অন্য জিনিসের। আর ওই হিজিবিজি ছোঁকরাও দু-নম্বরি জিনিস।
নবা চোখ গোল-গোল করে বলে, বটে ওস্তাদ!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টকাই বলে, এদের মতলব ভালো নয় রে নবা। জটাবাবার বেদিটা ভালো করে লক্ষ করেছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ, চৌকোমলতা, বেশ উঁচু।
হ্যাঁ, কিন্তু বেদি বানাতে মাটি বা ইটের দরকার হয়। এই জঙ্গলে তো ইটের জোগাড় নেই, আর আশপাশে কোথাও মাটি কাটার দাগও ছিল না। মনে হচ্ছে গোটাদুই বাক্সর উপর চট আর কম্বল দিয়ে ঢেকে বেদি করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাক্সটা কিসের। আরও কথা আছে।
নবা অবাক হয়ে বলে, আরও কী কথা ওস্তাদ?
আমি, তুই, জটাবাবা আর হিজিবিজি ছাড়া এই ঘরে আরও একটা কেউ ছিল।
কই ওস্তাদ, আর তো কাউকে দেখলুম না।
সব জিনিস কি চোখে দেখা যায় রে, তবে আন্দাজ পাওয়া যায়। আমি পাঁচ জনের শ্বাসের শব্দ পেয়েছি। রাতের অন্ধকারে যখন অচেনা বাড়িতে অন্ধকারে ঢুকতে হয়, তখন চোখ ততটা কাজ করে না, কিন্তু চোখের জায়গা নেয় কান। বুঝলি? তোর অবশ্য নাক, কান, চোখ, সবই সমান, সবকটাই ভোঁতা।
নবা লজ্জা পেয়ে বলে, তা বটে ওস্তাদ, কিন্তু ওই পাঁচ নম্বর লোকটা কে?
লোক কিনা তা জানি না! পাঁচ নম্বর যে মানুষই হবে এমন কোনও কথা নেই।
নবা শশব্যস্তে বলে, তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে ওস্তাদ?
পাঁচ নম্বরের শ্বাসের শব্দটা একটু অন্যরকম, অনেকটা খুব আস্তে শিষ দেওয়ার শব্দের মতো। আর শ্বাসটা অনেকক্ষণ বাদে-বাদে ছাড়ে।
সাপখোপ নয়তো!
না। দেশের সব সাপের শ্বাস আমার জানা। এ অন্য কিছু, মানুষ হলেও অন্যরকম মানুষ। শোন, জটাবাবার কাছে এসেছিলাম নিজের পাপ কবুল করে মন্তর নেব বলে, কিন্তু এখন অন্য কথা ভাবছি। জটাবাবা বোধহয় আমার চেয়েও এককাঠি উপরের জিনিস, সুতরাং এখনও রিটায়ার করলে আমার চলবে না, ব্যাপারটা দেখতে হবে।
৪. হাই বড় ছোঁয়াচে জিনিস
হাই বড় ছোঁয়াচে জিনিস। সামনে বসে যদি কেউ বড় বড় হাঁ করে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড হাই তুলতে থাকে, তা হলে তা দেখে সুমুখের মানুষটারও হাই উঠবেই কি উঠবে। নইলে এই সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় হাই তোলার মানুষ শিবেন নয়। কিন্তু উদ্ধববাবুর নাতি, সাঝঘুমোনি নাতি গোবিন্দকে সন্ধেবেলা পড়াতে এলে শিবেনের এই ফ্যাসাদটা হয়। গোবিন্দ যখন পড়তে বসে, তখনই তার ঢুলুঢুলু অবস্থা। প্রথম অঙ্কটা হয়তো কোনওরকমে কষল, শিবেন সেটা যখন দেখছে, তখনই গোবিন্দ টেবিলে মাথা রেখে ঘুমে তলিয়ে গেছে। তাকে ডেকে-হেঁকে ঝাঁকিয়ে, কাতুকুতু দিয়ে দ্বিতীয় অঙ্কটা করাতে বসালে গোবিন্দ অঙ্কের মাঝখানেই হাই তুলতে-তুলতে বারকয়েক ঢুলে পড়ে। আর তখন শিবেনেরও হাই ওঠে, ঢুলুনি আসে। তিন নম্বর অঙ্কে পৌঁছতে তাই অনেক সময় চলে যায়। গোবিন্দর ঘুম তাড়ানোর জন্য বাড়ির লোকও কম চেষ্টা করেনি। প্রথমে একজন ঢাকিকে আনানো হয়েছিল। কিন্তু ঢাকের বিকট শব্দে পাড়াপ্রতিবেশিরা অতিষ্ঠ হয়ে থানা-পুলিশ করবে বলে জানায়। তা ছাড়া গোবিন্দর ঘুম ঢাকেরও তোয়াক্কা করেনি বলে ঢাকের বদলে লঙ্কা পোড়া দিয়ে পড়ার ঘরে ধোঁয়া দেওয়া হল। তাতে গোবিন্দ যেমন নাকাল, তার চেয়েও বেশি নাকাল হল বাড়ির লোকেরা। সবাই হেঁচে-কেশে অস্থির। তারপর চোখে সর্ষের তেল, ঠান্ডা জলের ঝাঁপটা ইত্যাদি অনেক কিছুই করা হয়েছে। কিন্তু গোবিন্দর ঘুম তাতে নড়ার নামটিও করেনি। ওই ঘুমের জন্যই গোবিন্দর জনাসাতেক প্রাইভেট টিউটর কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে গেছে। তবে শিবেন ধৈর্যশীল মানুষ এবং ডাকাবুকো লোক। ময়নাগড়ে নতুন এসেছে ইশকুলে মাস্টারির চাকরি নিয়ে। তিন মাসেই লোকে জেনে গেছে শিবেনের অঙ্কের মাথা খুব পাকা, তাই তাকে নিয়ে ছাত্তরমহলে কাড়াকাড়ি। উদ্ধববাবু অনেক বেশি টাকা কবুল করে তাকে নিজের অপোগণ্ড নাতি গোবিন্দর জন্য নিয়োগ করেছেন। বলেছেন, বাপু হে, আশি-নব্বই নয়, অঙ্কে তিরিশটি নম্বর জোগাড় হলেই আমি খুশি। দু-মাস হল শিবেন লেগে আছে। গোবিন্দর তেমন কোনও উন্নতি হয়েছে বলে তার মনে হচ্ছে না। অঙ্কের উন্নতি না হলেও, দিন-দিন যে গোবিন্দর ঘুমের উন্নতি হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।
আজ অবিশ্যি গোবিন্দ পড়তে এসেই হাই তুলে বলল, জানেন মাস্টারমশাই, আজ দাদু ভূত দেখেছে।
শিবেন ভূতে বিশ্বাসী নয়, কৌতূহলও নেই। অঙ্কের বইয়ের পাতা ওলটাতে-ওলটাতে আনমনে শুধু বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ মাস্টারমশাই, লম্বা, ফরসা, ম্যাজিশিয়ান ভূত!
বটে! ভূত আবার ম্যাজিশিয়ানও হয়, কখনও শুনিনি তো!
গোবিন্দ তিন মিনিটের একটা ঢুলুনি সামলে নিয়ে বলল, তাকে পাঁচুও দেখেছে। তার নাম হিজিবিজি।
এতক্ষণ এসব কথায় তেমন গা করেনি শিবেন। এবার হঠাৎ চমকে উঠে বলল, কী নাম বললে?
গোবিন্দ পাক্কা পাঁচ মিনিট অঘোরে ঘুমিয়ে নিয়ে তারপর ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে বলল, ওঃ হ্যাঁ, তার নাম হিজিবিজি।
শিবেনের মুখটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। খানিকক্ষণ গোবিন্দর টেবিলের উপর নোয়ানো মাথাটার দিকে চেয়ে থেকে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলল, তা হলে কি সন্ধান পেয়েছে?
ঠিক এই সময় উদ্ধববাবু ঘরে ঢুকে খুবই উদ্বেগের গলায় বলে উঠলেন, সন্ধান পাবে কী করে হে! সে কি মনিষ্যি, যে সন্ধান পাবে?