একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টকাই বলল, শিবুর পিসেমশাইয়ের বয়স কত জানিস? একানব্বই বছর! হিসেব মতো থুথুড়ে বুড়ো, আর তুই ত্রিশ বছরের জোয়ান মর্দ। ঘাড়ে-গদানে চেহারা নিয়ে কোন আকেলে তুই বুড়ো মানুষটার হাতে নাকাল হলি বলতে পারিস?
মুশকিল কী জানো ওস্তাদ, আচমকা কাণ্ডটা হওয়ায় ঘাবড়ে গিয়েছিলুম কিনা! আর ঘাবড়ে গেলে আমার শরীরটা ভারী দুর্বল হয়ে পড়ে। তার উপর শিবুর পিসেমশাই হল গে বুড়ো মানুষ! বয়োজ্যেষ্ঠ, গুরুজন! বয়সের মানুষকে তো একটু সম্মান দেখাতে হয়! তাই তার অপমান হবে ভেবে পালাতে ইচ্ছে হল না।
তাই পায়ে ধরে কেঁদেকেটে ক্ষমা চেয়েছিলি?
না, পায়ে ধরার লোক আমি নই। যতদূর মনে আছে, হাঁটুর নীচে নামিনি। আর কান্না বলে লোকে মনে করলেও, ও ঠিক কান্না নয়। বেজায় সর্দি লেগেছিল বলে একটু ফ্যাচ ফঁ্যাচ ভাব ছিল। কান্না হতে যাবে কেন?
আর কান ধরে যে তোকে লোকজনের সামনে ওঠ বোস করাল, সেটা বুঝি অপমান নয়?
নবা একটু গ্যালগ্যালে হাসি হেসে বলল, তা ওঠ-বোস করেছি বইকি! সেদিন বিকেলে ডন-বৈঠক মারতে বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম কিনা! তা পিসেমশাই যখন ওঠ-বোস করতে বলল, তখন ভাবলুম, ভালোই হল! এই মওকায় মেরে নিই। হেঃ হেঃ, লোকে অবিশ্যি বুঝতে পারেনি। সবাই ভেবে নিল, আমি বোধহয় সত্যিই ভয় পেয়ে কান ধরে ওঠবোস করছি। কিন্তু আমি যে কায়দা করে বৈঠকি মারছি, সেটা আহাম্মকেরা ধরতেই পারেনি। হেঃ হেঃ, দিব্যি বোকা বানিয়ে এসেছি সবাইকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টকাই বলল, কেলেঙ্কারী যা করার তা তো করেইছিস, কিন্তু তা বলে কোন বুদ্ধিতে তুই শিবুর পিসেমশাইকে বলতে গিয়েছিলি যে, তুই আমার চেলা! নামটা ফাস করা কি তোর উচিত হল?
ভারী অবাক হয়ে নবা বলে, নাম নেব না মানে? আমি কত বড় ওস্তাদের শাগরেদ, সেটা পাঁচ জনকে বুক ঠুকে না বলে পারি? টকাই ওস্তাদের চেলা শুনলে যে লোকে হাতজোড় করে, পথ ছেড়ে দেয়।
বটে! তা হলে শিবুর পিসেমশাই সেটা করল না কেন? নবা একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ, সেটা একটা কথা বটে! তবে বুড়ো মানুষদের তো ভীমরতিতেও ধরে। তারপর ধরুন, কানেও হয়তো খাটো; তারপর ধরুন, ঝোঁকের মাথায় অপমানটা করে ফেলেছে, পরে হয়তো ক্ষমা চাইবে।
মাথা নেড়ে টকাই বলে, ওসব নয় রে, শিবুর পিসেমশাই হরদেব সিংহ আমার কাছে দুঃখ করে বলেছে, ওরে টকাই, তোর যে এমন দুরবস্থা হয়েছে, তা তো জানতুম না। তুই কত বড় ওস্তাদ ছিলি, লোকের পকেট মারলে পকেট নিজেও টের পেত না। আর সেই তুই কিনা এসব আনাড়ি লোককে দলে নিয়েছিস! এ তো চুরির অ-আ-ক-খই শেখেনি!
নবা ছলছল চোখে বলল, আরে ওস্তাদ, আমিও তো সেই কথাটাই আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। আপনি লাইন ছেড়ে দিলে আমার মতো অপদার্থ অপোগণ্ডের কী হবে! চুরি সমুদ্রের তীরে আমি যে এখনও নুড়ি কুড়োচ্ছি! জটাবাবা কী বলল শুনলেন না! চুরি মোটেই পাপের মধ্যেই পড়ে না। অত বড় সাধক, ত্রিকালজ্ঞ, টক করে চিত্রগুপ্তের খাতায় অবধি উঁকি মেরে এসে বললে, আপনার পাপের খাতায় কিছু জমা পড়েনি!
টকাই ভুকুটি করে বলল, জটাবাবা যাই বলুক, চুরিটুরি যে খারাপ কাজ তাতে সন্দেহ নেই। তবে চোর যদি হতেই হয়, তা হলে চোরের মতো চোর হওয়াই ভাল। দিনকানা, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন, বোকা-হাঁদা, লোভী আর চুকচুঁকে চোর হওয়া ঘেন্নার কাজ। হরদেববাবু কী আর সাধে দুঃখ করছিল, সে ছিল কদমপুরের ডাকসাইটে বড়দারোগা। জাহাবাজ লোক। সারা জীবনে মেলাই চোর-ডাকাত টিট করেছেন।
নব বড়-বড় চোখে চেয়ে বলে, দারোগা! শিবুর পিসেমশাই তা হলে দারোগা ছিলেন! তাই বলুন। অঙ্কটা তা হলে মিলেই গেল!
কী অঙ্ক মেলালি?
আজ্ঞে সে যখন আমাকে জাপটে ধরে পেড়ে ফেললে, তখনই আমি ওর গা থেকে পুলিশ-পুলিশ গন্ধ পেয়েছিলাম। চোর ধরার কায়দাকানুনও দেখলুম বেশ রপ্ত। তাই মনে হয়েছিল, এ-লোক পুলিশ না হয়ে যায় না। কিন্তু একে বুড়ো মানুষ, তার উপর গায়ে পুলিশের উর্দিও নেই, ফলে একটা খটকা লেগেছিল।
হ্যাঁ রে, পুলিশের গায়ে কী আলাদা গন্ধ থাকে?
নবা একগাল হেসে বলল, তা আর থাকে না! পুলিশের গন্ধ আমার খুব চেনা। সেবার গঁাদালপোয় মুরগি চুরির দায়ে যখন ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তখন দু-চারটে চড়চাপড় মেরে বড়বাবু শিবেশ্বর পুরকায়েত বলল, এটাকে আর ফাটকে পুরে কী হবে? বরং হাতে একটা হাতপাখা ধরিয়ে দে, সারারাত আমাকে বাতাস করুক, যা গরম পড়েছে! তা বড়বাবুকে সারারাত বাতাস করতে-করতে গন্ধটা খুব চিনে রেখেছিলুম। ও ভুল হওয়ার জো নেই। অনেকটা মোষ-মোষ গন্ধ।
তোর নাকের তো খুব এলেম দেখছি। তা ভাল চোরের মতো চোর হতে গেলে নাক-মুখ-চোখ সব কিছুই সজাগ হওয়াই দরকার। তা জটাবাবার কুটিরে ঢুকে কোনও গন্ধ পেয়েছিস?
তা আর পাইনি ওস্তাদ! খুব পেয়েছি। ফুল, চন্দন, আতর, ধূপকাঠি, সব মিলিয়ে মিশিয়ে ভারী স্বর্গীয় গন্ধ। মনে ভক্তিভাব এসে পড়ে।
তোর মাথা! এসবের নামগন্ধও ছিল না।
তা হলে?
ফাঁকা মাঠ, শুকনো পাতা আর মাটির সোঁদা গন্ধ ছাড়া আরও একটা সন্দেহজনক গন্ধ ছিল। সেটা হল স্পিরিট গামের গন্ধ।
সেটা কী জিনিস ওস্তাদ?
ওই আঠা দিয়ে যাত্রা-থিয়েটারের অ্যাক্টরের নকল দাড়ি গোঁফ লাগায়। মনে হচ্ছে জটাবাবার দাড়ি-গোঁফও আসল নয়।