অ্যাঁ! রূপকথা! মনসাপোতা নয়, সাতবেড়ে নয়, গাড়া শিবতলা নয়, একেবারে রূপকথা। এ আবার কেমন নাম হে! নামটা তেমন মজবুত নাম নয় তো! কেমন যেন এলিয়ে পড়া ভাব নামের মধ্যে! উচ্চারণ করে জুত হচ্ছে না তো!
আমাদের ভাষায় অবশ্য জায়গাটার নাম ডোডো।
নবা অবাক হয়ে বলে, বাড়িতে কি তোমরা ইংরিজিতে কথা কও নাকি?
না মশাই, আমরা ডোডো ভাষাতেই কথা কই। নবা হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, না বাপু, তোমার কথাবার্তা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
এদিকে যে এত কথাবার্তা হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে মোটেই খেয়াল নেই টকাইয়ের। সে জটাবাবার মুখের দিকে চেয়ে হাতজোড় করে সেই যে তদ্গত হয়ে আছে, আর কোনওদিকে হুঁশই নেই। ওদিকে জটাবাবাও সেই যে ধ্যানস্থ হয়েছেন, আর চোখ খোলেননি।
নবা গলাটা কয়েক পরদা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, তুমি কি জটাবাবার চেলা নাকি হে বাপু?
হিজিবিজি বলল, তা একরকম বলতে পারেন।
নবা একটা হাই তুলে বলল, তা ধর্মকর্ম হয়তো ভালো জিনিসই হবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, এতে তেমন গা গরম হয় না। চুরি-ছ্যাচড়ামির মধ্যে বেশ একটা গা গরম করা ব্যাপার আছে। ধর্মেকর্মে তো কেবল ভালো ভালো কথা আর উপদেশ। আমাদের কি ওসব পোষায়? তবে কিনা টকাই ওস্তাদের হঠাৎ বাই চেপেছে বলে আসা। তা জটাবাবা তো পষ্টাপষ্টি বলেই দিলেন যে, চুরি করা তেমন খারাপ কিছু নয়। এখন ফিরে গিয়ে কাজকর্মে মন দিলেই বাঁচি। তা বাপু, তোমরা চোর খুঁজছ কেন? সুলুকসন্ধান কিছু আছে নাকি?
হিজিবিজি ভারী মিষ্টি হেসে বলল, আছে বইকি।
নবা সাগ্রহে বলল, আহা; একটু খোলসা করে বলেই ফ্যালো না। তেমন বড় দাঁও হলে ওস্তাদকে আমি ঠিক রাজি করিয়ে ফেলব।
হিজিবিজি ভালো মানুষের মতো মুখ করে বলল, আজ্ঞে, চোর খুঁজছি আমাদের দেশে নিয়ে যাব বলে।
নবা অবাক হয়ে বলে, যাঃ, চোর আবার কেউ নিয়ে যায় নাকি? কেন বাপু, তোমাদের গাঁয়ে কি চোর নেই নাকি?
আজ্ঞে না। চোরের বড়ই অভাব। তবে কি সেখানে সবাই ডাকাত?
ডাকাতই বা দেখলাম কোথায়? না মশাই, চোর-ডাকাত ওসব কিছুই আমাদের নেই। সেই জন্যই গোটাকয়েক চোর আর ডাকাত নিয়ে যেতে চাইছি লোককে দেখাব বলে।
নবা চিন্তিত হলে বলে, চোর-ডাকাত নেই? সে আবার কেমন জায়গা হে! এ তো মোটেই ভালো কথা নয়! ভগবানের দুনিয়ায় বাঘ-সিংহ, শেয়াল-কুকুর, বিড়াল-হঁদুর, কাক-বক, কোনওটা বাদ দিলে কি চলে? তোমাদের বাপু সৃষ্টিছাড়া গাঁ। রূপকথায় গিয়ে আমাদের জুত হবে না হে।
ঠিক এই সময়ে ধ্যানস্থ জটাবাবা হঠাৎ বাঁ-চোখটা পট করে খুলে টকাইয়ের দিকে তাকালেন। তারপর বজ্রনির্ঘোষে বললেন, যা ব্যাটা, ধ্যানযোগে গিয়ে চিত্রগুপ্তের খাতায় তোর পাপপুন্যির হিসেবটায় চোখ বুলিয়ে এলুম। না, চুরি বাবদ তোর পাপের খাতে কিছুই ধরা হয়নি। নিশ্চিন্তে বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমো। সামনের অমাবস্যায় রাত এগারোটায় এইখানে চলে আসবি। পাপতাপ যা করেছিস, সব ঝেড়ে নামিয়ে দেব। তারপর মন্তর পাঠ। এখন বিদেয় হ।
গদগদ হয়ে টকাই তাড়াতাড়ি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে পড়ল, সঙ্গে নবাও।
জটাবাবার ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকটা তফাত হওয়ার পর হঠাৎ টকাইয়ের ভক্তিভাবটা খসে গিয়ে কপালে সুকুটি দেখা দিল। গম্ভীর গলায় ডাকল, নবা!
নবা পিছন থেকে বলল, আজ্ঞে!
চুরি-ডাকাতি খুব খারাপ জিনিস, বুঝলি!
যে আজ্ঞে, তবে কিনা…
টকাই হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল, এ কথাও ঠিক যে, চুরি-ডাকাতির উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
যে আজ্ঞে, সেই কথা ভেবে ভেবেই তো আমার রাতে ঘুম নেই। কাল রাতেই তো গিন্নি ফুলকপি দিয়ে কই মাছ বেঁধেছিল। এক কাঠা চালের ভাত উড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কী বলব ওস্তাদ, দু-গরাসও গিলতে পারিনি।
টকাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই কতকাল আমার শাগরেদি করছিস বল তো নবা?
তা ধরুন, সামনের অঘ্রানে দশ বছর পুরবে।
দশটি বছর আমার সঙ্গে থেকে শিখলি কী বল তো! এখনও তোর দেখার চোখ ফুটল না। কান তৈরি হল না, মগজ সজাগ হল না, হাত-পায়ের আড় ভাঙল না। সেই যে প্রথম দিন তোকে পরীক্ষা করার জন্য পটলার সাইকেলখানা চুরি করে আনতে পাঠিয়েছিলাম, সে-কথা মনে আছে?
ভারী লজ্জা পেয়ে বা বলে, তা আর নেই! খুব মনে আছে।
জলের মতো সোজা কাজটা যেভাবে ভণ্ডুল করেছিলি, তাতেই এলেম বোঝা গিয়েছিল তোর।
নবা কঁচুমাচু হয়ে বলল, তা কী করব ওস্তাদ, হাঁদারাম পটল যে তার সাইকেলের পিছনের চাকায় শেকল পরিয়ে তালা দিয়ে রেখেছে, তা কে জানত? সাইকেলটা টেনে নিয়েই চটপট উঠে পড়ে চালাতে গিয়েই দড়াম করে পড়লুম যে! প্রথম কেস তো!
সে না হয় হল। প্রথমটায় লোকে ভুলচুক করতেই পারে। সেটা ধরছি না। কিন্তু এই গেল হপ্তায় শিবু সমাদ্দারের বুড়ো পিসেমশাইয়ের হাতে ধরা পড়ে যে পঞ্চাশবার কান ধরে ওঠবোস করলি, তাতে যে আমার কতখানি বেইজ্জত হল, তা খেয়াল করেছিস?
নবা ভারী অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে ওস্তাদ, পাকা খবর ছিল যে, শিবু সেদিন মাদারপুরে শ্বশুরবাড়িতে গেছে। তাই নিশ্চিন্তে তার ঘরে ঢুকে মনের আনন্দে জিনিসপত্র সরাতে লেগেছিলাম। তা মেলা খুচরো জিনিস হয়ে যাওয়ায়, ভাবলুম, বিছানার চাঁদরে বেঁধে একটা পোঁটলা করে নিলে সুবিধে হবে। তখন কী আর টের পেয়েছিলাম যে, বিছানায় শিবুর বুড়ো পিসেমশাই শুয়ে আছে। মাইরি, বিশ্বাস করুন, শিবুর যে কস্মিনকালে কোনও পিসেমশাই আছে, সেটাও আমার জানা ছিল না। কোন গোবিন্দপুর গাঁ থেকে সেদিন রাতেই এসে হাজির হয়েছে। তা পোঁটলা বেঁধে তুলতে গিয়ে দেখি বেজায় ভারী। তখন কী আর জানতুম যে, জিনিসপত্রের সঙ্গে শিবুর পিসেমশাইও পোঁটলাসই হয়েছে! কেঁদে ককিয়ে পোঁটলা সবে ঘাড়ে তুলেছি, অমনই পোঁটলার ভিতর থেকে দুখানা হাত বেরিয়ে এসে গলাটা পেঁচিয়ে ধরে বড্ড বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। প্রথমে ভেবেছিলুম, ভূত! তাই একটু চেঁচামেচিও করে ফেলেছিলুম বটে! কপালটাই আমার খারাপ! নইলে পোঁটলার হাত গজাবে কেন?