হিজিবিজি নামের ছেলেটা তার হাতের যন্ত্রটা ঝোলায় পুরে টকাইয়ের দিকে চেয়ে বেশ হাসি-হাসি মুখ করে বলল, আপনি চুরি করেন বুঝি?
জটাবাবা যখন একে নেকনজরে দেখেন, তখন ইনিও একজন মহাত্মাই হবেন ভেবে টকাই হাতজোড় করে বলল, যে আজ্ঞে, নিজের উপর বড় ঘেন্না হচ্ছে আজকাল। তা আপনারা সাধু-মহাত্মা লোক, আপনারা যদি ভেবেচিন্তে একটা নিদান দেন তো প্রাণটা জুড়োয়।
হিজিবিজি একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা যে একজন ভাল চোরই খুঁজছি। কিন্তু মনের মতো চোরই কি আর পাওয়া যায়? এ পর্যন্ত অনেক বেছেগুছে সাতজনকে বের করেছি বটে। কিন্তু তাদেরও নানা খাকতি। কারও হাত চলে তো পা চলে না, কেউ দিনকানা, কেউ ভারী আনমনা, কারও বা ভূতের ভয়। তা আপনি কেমন চোর?
নবা হঠাৎ ফুঁসে উঠে বলল, তুমিই বা কেমন লোক হে ছোঁকরা, টকাই ওস্তাদের মুখের উপর জিগ্যেস করছ, কেমন চোর? এ তল্লাটে যার কাছে টকাই ওস্তাদের নাম বলবে, সে-ই জোড়হাত কপালে ঠেকাবে। বলি, টকাই ওস্তাদের নাম শোনোনি, এতদিন কি বিলেতে ছিলে নাকি?
টকাই বিরক্ত হয়ে নবাকে ধমক দিয়ে বলে, আঃ, সাধুমানুষের সঙ্গে ওভাবে কথা কইতে আছে? ওঁরা সাধনভজন নিয়ে থাকেন, চুরি-চামারির খবর রাখবেন কী করে?
ছেলেটা হঠাৎ চোখ বড়-বড় করে বলল, ও, আপনিই টকাই ওস্তাদ? তাই বলুন, আপনি তো প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ।
নবা বুক চিতিয়ে বলল, তা হলেই বুঝে দ্যাখো বাপু, কার সঙ্গে কথা কইছ! তিন-তিনবার নিখিল ভারত পরস্পাপহরক সমিতির বর্ষসেরা হয়ে সোনার মেডেল পেয়েছেন। রাজ্যস্তরে পাঁচবার চোর-চ্যাম্পিয়ন। দেশের সেরা সম্মান তস্কররত্নও দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। টকাই ওস্তাদের মর্ম তুমি কী বুঝবে হে সেদিনের ছোঁকরা?
হিজিবিজি লাজুক একটু হেসে ভারী লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, ছি ছি, এরকম একজন গুণী মানুষকে চিনতে না পারায় ভারী বেয়াদপি হয়ে গেছে। আমি ছোট ছেলে বলে মাপ করে দিন। মাত্র বারো বছর বয়স, কত কী শেখার বাকি!
নবা চোখ পিটপিট করে বলল, কার বারো বছর বয়স?
আমার কথাই বলছি।
শোনো বাপু, একসময় মালদহে দুশো আমকে একশো বলে ধরা হত। দেদার আম ফলত বলে ওটাই ছিল রেওয়াজ। একশো আম কিনলে একশো আম ফাউ। তা তুমি কত বছরে এক বছর ধরছ?
ছেলেটা মিষ্টি হেসে বলল, হিসেব খুব সোজা। আমাদের দেশে আঠারো মাসে বছর কিনা!
কেন হে বাপু, তোমাদের আঠারো মাসে বছর কেন? বারো মাসে সুবিধে হচ্ছে না বুঝি!
আমাদের বছর বড় গড়িমসি করে ঘোরে যে! তার বড্ড আলিস্যি। তার উপর আপনাদের চেনা তিরিশটি দিন পেরোলেই মাস পুরে যায়। আমাদের কী তা হওয়ার জো আছে? মাস আর পুরোতেই চায় না। গড়াতে-গড়াতে সেই একশো কুড়ি দিনে মাস পূর্ণ হয়।
চোখ গোল-গোল করে শুনছিল নবা, বলল, ও বাবা! এ যে একেবারে বোম্বাই মাস হে বাপু! মাসমাইনে পেতে গেরস্তের যে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়। একশো কুড়ি দিন মানে কত হপ্তায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে বলো তো?
হপ্তা? না মশাই, আমাদের হপ্তা নেই। আমাদের হল। দশ!
দশ জন্মে শুনিনি বাপু, সে আবার কী বস্তু? ভারী লজ্জায় মরমে মরে গিয়ে হিজিবিজি বলে, আপনাদের যেমন সাতদিনে হপ্তা, আমাদের তেমনই দশতা। আমাদের বড় ঢিলাঢালা ব্যাপার মশাই। সকালে সুয্যিঠাকুর উদয় হলেন বটে, কিন্তু তারপর আর নড়তেই চান না। মধ্য গগনে উঠছেন, যেন বেতো রুগি। সকালে আমাদের বারতিনেক প্রাতঃরাশ করতে হয়। মধ্যাহ্নভোজনও কম করে বারতিনেক। নৈশভোজও ধরুন তিন থেকে চারবার।
বাপ রে! তবে তো খেয়েই তোমরা ফতুর!
তা তো বটেই। কিন্তু কী করা যাবে বলুন! আমাদের যে বাহাত্তর ঘণ্টায় একটা দিন।
বলো কী হে?
তাও যদি আপনাদের ঘণ্টার মতো চটজলদি ঘণ্টা হত। তা ধরুন, আমাদের ঘণ্টার মাপটাও একটু বেঢপ রকমের। মোট একশো আশি মিনিট।
বটে হে!
তার উপর আবার এক মিনিটও কী সহজে হয়? দুশো চল্লিশ সেকেন্ড পর মিনিটের কাঁটা নড়ে।
বাপ রে! না বাপু, তা হলে তোমার ন্যায্য বারো বছর বয়সই বটে। বরং একটু বেশিই ধরা হচ্ছে। আট কী সাত হলেই যেন মানায়। তা তোমাদের দেশটা কোথায় বলল
তো! শুনেছি, বিলেতে নাকি ওরকম সব অশৈলী কাণ্ড হয়। সেখানে কাকের রং সাদা, বিধবাদের একদাশী নেই, শীতকালে আকাশ থেকে কাঠি-বরফ পড়ে।
হিজিবিজি ভাল মানুষের মতো মুখ করে বলে, বিলেত নয়, আমার দেশটা একটু দূরে। নবা মাথা নেড়ে বলে, তা হয় কী করে? বিলেতের পরই তো পৃথিবী শেষ। তারপর আর ডাঙা জমিই নেই।
আমার দেশটা ওদিকপানে নয় কিনা!
তবে কোন দিকটায় বলো তো! সাতবেড়ে পেরিয়ে নাকি? সাতবেড়েয় আমার খুড়শ্বশুরের বাড়ি কিনা! জব্বর জায়গা। তা শুনেছি বটে সাতবেড়ে পেরিয়ে ঘুরঘুট্টি নামে একটা জায়গা আছে, সেখানে হাটে ভূতের তেল বিক্রি হয়। সেখানে নৃমুণ্ডমালিনী নামে এক ধরনের গাছ আছে, লাল টকটকে ইয়া বড়-বড় ফুল হয়, তারপর ফুলের ভিতর থেকে নরমুণ্ডের মতো ফল বেরোয়। সেই গাছে পাখি বাসা বাঁধে না, তলা দিয়ে মানুষ কেন, কুকুর-বিড়ালও যায় না। কাছে গেলেই কপাত করে গিলে ফেলে। তা কানাঘুষো যেন শুনেছিলাম যে, সেখানেও দিন-রাত্তির একটু অন্য নিয়মের।
আমার দেশের নাম ঘুরঘুট্টি নয়। তা হলে?
সে আরও বেনিয়মের জায়গা মশাই! দেশটার নাম হল রূপকথা।