নবা জানে, ওস্তাদের আজকাল বড় অনুতাপ যাচ্ছে। সাবধানে কথা কইতে হয়। সে মোলায়েম গলায় ফিসফিস করে বলল, আজ্ঞে, আপনি জ্ঞানী মানুষ, আপনার কথার উপরে তো কথা চলে না। তবে কিনা ওস্তাদ, আমরা কি আর ইচ্ছে করে চুরি করি? আমাদের পেট আর অদৃষ্টই যে এ-লাইনে টেনে আনল, আমাদের দোষ কী বলুন!
টকাই তবু ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল, ওটা কোনও যুক্তি নয় রে নবা! অভাব, কষ্ট, পেটের দায় থাকলেই কি আর লোকে চুরি করে? তা হলে তো ভিতরে ভিতরে আমি দগ্ধে মরে যাচ্ছি। সোনাদানা, টাকাপয়সায় আমার বড় অরুচি হয়েছে। এখন আমার সাধুসঙ্গ করা দরকার। খোঁজ নে তো, ভালো সাধু কে আছেন কাছেপিঠে। ধর্মকথা না শুনলে আমার মনটা শান্ত হবে না রে।
ওস্তাদের কথা অমান্যই বা করে কী করে? তাই নবা পরদিন থেকে খুঁজতে শুরু করে তেরাত্তিরের মাথায় খবর আনল, ময়নাগড়ের উত্তরের জঙ্গলে একজন সাধুগোছের লোক আছেন বটে, তার নাম জটাবাবা। জনসমক্ষে বড় একটা বেরোন না। জঙ্গলের মধ্যে কুটির বানিয়ে আপন মনে সাধনভজন নিয়ে থাকেন।
শুনে টকাইয়ের চোখ উজ্জ্বল হল। বলল, বাঃ, এরকম সাধুই তো চাই।
টকাইয়ের অগম্য জায়গা নেই। পরদিন সকালেই সে ময়নাগড়ের উত্তরের জঙ্গলে গিয়ে হাজির হয়ে গেল। পেত্নি জলার ধারে ফলসাবন, সেটা পেরিয়ে গহীন জঙ্গল। তার মধ্যে একটা বটগাছের তলায় জটাবাবার কুটির খুঁজে বের করতে বিশেষ কষ্ট হল না টকাইয়ের।
কুটিরের চেহারা দেখে অবশ্য কুটির বলে বোঝবার উপায় নেই। রাজ্যের ডালপালা, পাতানাতা দিয়ে কোনওরকমে একটা স্থূপাকার জিনিস খাড়া করা হয়েছে। উপরে খেজুরপাতার ছাউনি, কুটিরে ঢোকার একটা ফোকর আছে বটে, তবে দরজা-জানলার বালাই নেই। বাইরে থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হয়, রাজ্যের শুকনো গাছপালা কেউ জড়ো করে রেখেছে। লোকের বাড়িতে রাতবিরেতে ঢোকা টকাইয়ের কাছে জলভাত। কিন্তু সাধু-মহাত্মাদের ঠেক-এ তো আর ওরকমভাবে ঢোকা যায় না। তাই টকাই বাইরে থেকেই হাত জোড় করে জটাবাবার উদ্দেশ্যে মোলায়েম গলায় বলল, বাবা!
ভিতর থেকে প্রথমটায় কোনও সাড়া এল না। গলাখাঁকারি দিয়ে টকাই ফের ডাকল, বাবা!
সাড়া নেই। বারপাঁচেক ডাকাডাকির পর ভিতর থেকে একটা বাজখাই গলা বলল, কে তুই?
আজ্ঞে, আমি এক পাপিষ্ঠ। আমার নাম টকাই।
কী চাস?
টকাই গদগদ গলায় বলল, আপনার দয়া চাই বাবা।
ভিতরে আয়।
ফোকরটা দিয়ে সাবধানে বুক ঘষটে ঢুকে পড়ল টকাই, সঙ্গে নবাও।
ভিতরটা অন্ধকার বটে, কিন্তু অন্ধকারেই টকাইয়ের কাজকারবার বলে সে সবই স্পষ্ট দেখতে পেল। একটা কম্বলে ঢাকা উঁচু বেদির মতো আসনে জটাজুটধারী লম্বাটে রোগা চেহারার বেশ তেজস্বী একজন মানুষ বসে আছেন। দাড়িগোঁফ কালোই বটে, তবুও বয়স হয়েছে বোঝা যায়। এই শীতেও খালি গা, তাতে ছাইমাখা। পাশে চিমটে, কমণ্ডলু, বেদির একপাশে বৌলওলা খড়ম। সামনে ধুনি জুলছিল, তবে এখন মিইয়ে গিয়ে ধিকিধিকি ছাইচাপা একটু আগুনের আভাস দেখা যাচ্ছে মাত্র। ধুনির বাঁ-ধারে একটা লম্বাপনা ফরসামলো ছোঁকরা বসে আছে। তবে তাকে সাধুর চেলা বলে মনে হয় না। তার গায়ে ঢোলা পোশাক, একটা বাদ্যযন্ত্র আর একটা পোঁটলা।
জটাবাবাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে টকাই আর নবা ঠান্ডা ভেজা-ভেজা মাটিতেই বসে পড়ল।
জটাবাবা মিটমিট করে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, সঙ্গে ওটি কে?
জোড়হাতে টকাই বলল, আর-এক পাপিষ্ঠ, আমার সাঙাত নবা।
জটাবাবা মজবুত সাদা দাঁত দেখিয়ে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, কী পাপ করেছিস বল তো?
আজ্ঞে, আমি চোর।
জটাবাবা যেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। একটু ভেবে বললেন, তা চুরি করা কি পাপ?
পাপ নয়! বলেন কী মহারাজ? চুরি করা তো ভয়ংকর পিপ বলেই জানি।
জটাবাবা যেন আরও চিন্তিত হয়ে বললেন, সে তো শুনলাম, কিন্তু কোন আইনে পাপ হচ্ছে সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। ওরে বাপু হিজিবিজি, তুই জানিস?
যে ছেলেটা ধুনির পাশে বসেছিল সে হাতে একটা চৌকোমতো ক্যালকুলেটর গোছের যন্ত্রে কী যেন দেখছিল। অখণ্ড মনোযোগ।
এ কথার জবাব দিল না। একটুক্ষণ হাতের যন্ত্রটার দিকে চেয়ে থেকে তারপর মাথা নেড়ে বলল, না, জানি না।
ফাঁপরে পড়ে টকাই বলল, চুরি করা তো সবাই পাপ বলেই জানে।
জটাবাবা ভাবিত মুখে বললেন, তা জানলেই তো হবে। দুনিয়ার সব জিনিসই ভগবানের সৃষ্টি, নাকি রে? আজ্ঞে, সে তো ঠিকই।
তুইও ভগবানেরই সৃষ্টি জীব।
যে আজ্ঞে, তাই তো হওয়ার কথা।
তা হলে ভগবানের যা কিছু সৃষ্টি, সবতাতেই তোর হক আছে। তা হলে অন্যের জিনিস বলে তো কিছু নেই। সবই তোর এবং সবার। তা হলে চুরিকে পাপ বলি কী করে?
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নড়েচড়ে বসে টকাই বলল, তা হলে কি চুরি করা পাপ নয় বাবা? লোকে কি ভুল বলে?
জটাবাবা গভীর চিন্তিত মুখে বলেন, ওরে দাঁড়া, দাঁড়া। অত হুড়ো দিলে কি হয়? ধর, গাছ থেকে একটা ফল পেড়ে নিলি, সেটাও কি গাছের সম্পত্তি নয়? তা হলে সেও তো চুরি! যদি হিসেব করে বিচার করে দেখিস, তা হলে মানুষেরপ্রায় সব কাজই তো চুরির খাতেই ধরতে হয়।
তা হলে কি আমার পাপ হয়নি বাবা?
উঁহু, তাও বলা যাচ্ছে না। আরও ভেবে দেখতে হবে। এই সক্কালবেলায় এসে বড় চিন্তায় ফেলে দিলি বাপ! ওরে বাপু হিজিবিজি, একটু ভেবে দ্যাখ তো, চুরিটাকে পাপের খাতে ধরা যায় কিনা।