লোকটা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, চোপ, এখন গন্ডগোল কোরো না, আমি মিয়া তানসেন, তমিজের গান শুনতে চলে। এসেছি। সেই কথা শুনে রামলাখনের দাঁতকপাটি লেগেছিল।
কথাটা হল, এইসব গুণী মানুষের পাশাপাশি টকাইকেও ধরতে হয়। ওরে বাপু, গাঁ-দেশে চোরের অভাব কী? তবে সেইসব নির্ঘিম্নে চোরেদের দলে তো আর টকাইকে ফেলা যায় না। ছা-পোষা গেরস্তদের ঘরে সে কখনও পায়ের ধুলো দেয়নি। নজর সর্বদা উঁচু। লাখপতি, কোটিপতি ছাড়া তার রোচে না। তার গুণের কথা না বললে অধর্ম হবে। কাউকে সে সর্বস্বান্ত করে আসে না। লাখ টাকার নাগাল পেলেও সে অর্ধেকটা ছেড়ে অর্ধেকটা নেয়। কারও বাড়িতে আবার পরদিনের বাজার-খরচ রেখে আসে।
গোবরদহের মহেন্দ্র সৎচাষির বিশটি হাজার টাকা সে লোপাট করেছিল বটে, কিন্তু তার খোকাখুকুর জন্য রঙিন পোশাক, খেলনা আর তার বউয়ের জন্য দামি শাড়ি রেখে এসেছিল।
লোকে তাই পঞ্চমুখে বলে, হ্যাঁ, টকাই সহবত জানে বটে।
প্রতাপপুরের নকুল প্রতিহার সেদিন চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডায় নিজের বাড়ির চুল্লির গল্প ফেঁদে বলল, যাই বলল, এমন চোরের কাছে বোকা বনেও সুখ। কী বলব ভাই, দরজায় ভিতর থেকে লোহার বাটাম দেওয়া, তালা মারা, তার উপর আমার সজাগ ঘুম। শেষরাত্রে দেখি, দরজা যেমনকে তেমন বন্ধ আছে। পাশের দরজাটাও দেখলাম আঁট করে সাঁটা, বাথরুম ঘুরে এসে জল খেয়ে শুতে যেতেই হঠাৎ খটকাটা লাগল। আচ্ছা, আমার সদর দরজা তো একটা! তবে দুটো দরজা দেখলাম কেন? তাড়াতাড়ি উঠে বাতি জ্বেলে দেখি, কী বলব ভাই, দেওয়াল কেটে রাতারাতি কে যেন ভারী যত্ন করে দুনম্বর দরজাটা বানিয়ে গেছে। তখন চৈতন্য হল, তাই তো, খালধারের জমি বেচে লাখদুই টাকা পেয়ে লোহার আলমারিতে রেখেছিলাম যে! তা দেখলাম, আলমারিটাই নেই। অবশ্য তার বদলে ঝাঁ-চকচকে একটা নতুন আলমারি কেউ দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে। তাতে লাখখানেক টাকা যত্ন করে রাখা আছে। আমার বউয়ের চল্লিশ ভরি গয়না নেই বটে, কিন্তু মেয়ের বিয়ের জন্য গড়ানো গয়নাগুলো সাজিয়ে রেখে গেছে। রাগ করব কী মশাই, চোখে জল এল। কই হে পোদ্দার, তোমার সেই গল্পটা বলো না, সবাই শুনুক।
বিরিঞ্চি পোদ্দার মুখ থেকে হুঁকোটা সরিয়ে বলল, ওঃ, সে এক কাণ্ডই বটে। মাঝরাত্তিরে হঠাৎ সংস্কৃত মন্ত্র পাঠ হচ্ছে শুনে ধড়মড় করে উঠে দেখি, পাশের ঘরে তিন চারজন জটাজুটধারী সাধু মাঝখানে ধুনি জ্বেলে একমনে যজ্ঞ করছে। দেখে তো আমি আর গিন্নি ভ্যাবাচ্যাকা। অশৈলী কাণ্ড যাকে বলে! কিছুই বুঝতে না পেরে আমি আর গিন্নি গুটি-গুটি গিয়ে জোড়হাতে পিছনে বসে যজ্ঞ দেখতে লাগলাম। বলব কী ভাই, বিশুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্রে নিখুঁত যজ্ঞ।
দেখলে পাষণ্ডেরও ভক্তিভাব এসে পড়ে। তা ঘণ্টাখানেক মুগ্ধ হয়ে যজ্ঞ দেখলাম। তারপর বড় সাধু আমার দিকে ফিরে বলল, অবাক হচ্ছিস যে ব্যাটা! এই সাড়ে তিনশো বছর বয়সে হিমালয় থেকে এতদূর ঠেঙিয়ে কি এমনি এসেছি রে আহাম্মক! তোর রিষ্টি কাটাব বলেই আসা। নে, যজ্ঞের তিলক কপালে সেঁটে এবার নিশ্চিন্তে ঘুমো। রিষ্টি কেটে গেছে।
আমি খুঁতখুঁত করে বললাম, যজ্ঞ করলেন, সে তো খুব ভালো কথা! কিন্তু একটু ডাকলেও তো পারতেন, দরজা খুলে দিতুম।
সাধু অট্টহাসি হেসে বলে, কোনও দরজা কি আমাদের আটকাতে পারে রে বোকা! সূক্ষ্ম দেহে সর্বত্র যাতায়াত। ডাকাডাকি করে পাড়াসুদ্ধ লোকের ঘুম ভাঙানো কি ভালো রে বদ্ধ জীব? তা হলে যে সবাই টানাহ্যাঁচড়া করে তাদের বাড়িতে নেওয়ার চেষ্টা করত। এবারটায় শুধু তোর জন্যই আসা কিনা!
তা সেই কথা শুনে কেমন যেন ভ্যাবলা হয়ে গেলাম, মাথাটা কাজ করছিল না। গিন্নি তো কেঁদেকেটে একশা। ধাঁ করে একশো এক টাকা প্রণামী দিয়ে ফেলল। তা সাধুরা। প্রণামী ছুঁলও না। বড়সাধু বলল, টাকাপয়সা নোংরা জিনিস। ওসব আমরা দুই না। গিন্নি তখন হাতের দু-গাছা বালা খুলে দিয়ে বলল, না নিলে গলায় দড়ি দেব বাবা।
সাধু নাকটাক কুঁচকে চেলাদের বলল, নে, তুলে নে। গরিব-দুঃখীর কাজে লাগাস। তারপর তারা বিদায় হল। পরদিন সকালে দেখি, আলমারি আর বাক্স-প্যাটরা সব ফাঁক। ও চোর শুধু চুরি করতেই আসে না রে ভাই, শিক্ষেও দিতে আসে।
সবাই একমত হয়ে বলল, তা বটে!
.
তা টকাইয়ের নামডাক আছে বটে, কিন্তু ইদানীং তার কেমন যেন একটু বৈরাগ্য এসেছে। সারাদিন ক্ষণে-ক্ষণে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে আর মাঝে-মাঝে হাহাকার করে ওঠে, ওঃ বড় পাপ হয়ে গেল রে।
তার চেলাচামুণ্ডার অভাব নেই। চেলাদের মধ্যে নবা হল তার একেবারে ছায়া। সর্বদা সঙ্গে সেঁটে আছে। সেবাটেবাও করে খুব। তা টকাইয়ের এসব লক্ষণ তার মোটেই ভালো ঠেকছে না।
বেড়ে বিষ্ণুপুরের মহাজন হরমোহন পালের গদিতে হানা দিয়েছিল টকাই। গেল হপ্তার রোববারের ঘটনা। চারখানা জাম্বুবান তালা চোখের পলকে খুলে ফেলল। ভিতরে ঢুকে মজবুত লোহার সিন্দুকের গায়ে মোলয়েম করে হাত বোলাল, আর তাইতেই সিন্দুকের ভারী পাল্লাটাও যেন অবাক হয়ে হাঁ করে ফেলল। ভিতরে না হোক বন্ধকি গয়না আর মোহর আর রুপোর জিনিস মিলিয়ে তিন-চার লাখ টাকার মাল। টকাই তবু শেষ মুহূর্তে হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল, এসব করা কি ঠিক হচ্ছে রে। লোকে কত খেটেপিটে রোজগার করে, কত কষ্টে এক পয়সা দুপয়সা করে জমায়। আর আমি পাষণ্ড সেসব লেপেপুঁছে নিয়ে আসি। এ কি ভালো? এসব পাপের কি ক্ষয় আছে? সাত বছর গঙ্গায় ডুবে থাকলে বা সাত হাজার ব্রাহ্মণভোজন করালেও গা থেকে পাপের গন্ধ যাবে না। মরার পর যমরাজা হয়তো আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বলবেন, ওরে বাপ, এই ঘোর পাপীটাকে নরকে দিলে যে নরকও অপবিত্র হয়ে যাবে।