পরাণের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। নয়নতারা কটমট করে কথা কয় বটে, কিন্তু অন্যায্য কথা কয় না। কাজকর্মে সে তত পাকাঁপোক্ত নয়, একথা সে নিজেও জানে। নইলে এই গ্রীষ্মেকালে বদন মণ্ডল, পাঁচু গড়াই, গেনু হালদারের তো রোজগার বন্ধ হয়নি। বদন তো পরশুদিনই রায়বাড়ির গিন্নিমার সীতাহার হাতিয়ে এনে সেই আনন্দে আস্ত বোয়াল মাছ কিনে ফেলল। পাঁচু গড়াই বিষ্টু সাহার দোকান থেকে ক্যাশ বাক্স ভেঙে সাতশো একান্ন টাকা পেয়ে একজোড়া জুতো কিনেছে। গেনু হালদার দিন দুই আগে এক রাতে দু-দুটো বাড়িতে হানা দিয়ে এক পাঁজা রুপোর রেকাবি আর দুটো আংটি হাতিয়ে এনেছে। আর পরাণ একটা পেতলের ঘটিও রোজগার করতে পারেনি। গতকাল অনেক কসরত করে কষ্টেসৃষ্টে সতু ঘোষের বাড়িতে ঘরের জানালার শিক বেঁকিয়ে ঢুকেছিল বটে। শেষ অবধি দুটো কাঁচের ফুলদানি ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। ফুলদানির তো আর বাজার নেই। বউ সে দুটো ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েছিল। শেষ অবধি তাকে তুলে রেখেছে।
বুকটা দমে গেছে পরাণের। খোরাকির পয়সাটাও না জুটলে তো বউয়ের কাছে মুখই দেখানো যাবে না।
অধোবদনেই পান্তা খাচ্ছিল পরাণ। গলা দিয়ে যেন হড়হড়ে পান্তাও আজ নামতে চাইছে না।
হঠাৎ দরজায় একটা খুটখুট শব্দ হল। শব্দটা মোটেই ভাল মনে হল না পরাণের। কেমন যেন গা ছমছমে শব্দ।
সে চট করে ঘটির জলে হাতটা ধুয়ে ফেলে চাপা গলায় নয়নতারাকে বলল, “আমি মাচানের তলায় লুকোচ্ছি। জিজ্ঞাসাবাদ না করে দরজাটা খুলো না।” বাঁশের মাচানটার ওপর তাদের কাঁথাকানির বিছানা, মাচানের তলায় রাজ্যে হাঁড়িকুড়ি। পরাণ গিয়ে হামা দিয়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। পুলিশ এলেও তার তেমন দুশ্চিন্তার কারণ নেই। গত কয়েকদিন এ বাড়িতে চোরাই জিনিস আসেনি বললেই হয়। ওই দুটো কাঁচের ফুলদানি ছাড়া। কাঁচের ফুলদানি ফঙ্গবেনে জিনিস, তার জন্য কি আর পুলিশ গা ঘামাবে?
নয়নতারা টেমি হাতে নিয়ে উঠে গিয়ে দরজার ভিতর থেকেই সতর্ক গলায় বলল, “কে? কী চাই?”
বাইরে থেকে একটা ঘড়ঘড়ে গলা বলল, “ভয় নেই মা, আমি বুড়ো মানুষ। দরজাটা খোলো।”
দরজা এমনিতেই পলকা, বেড়ালের লাথিতেও ভেঙে যাবে। তার ওপর হুড়কো ভাঙা বলে নারকোলের দড়ি দিয়ে কোনওক্রমে বাঁধা।
নয়নতারা তাই সাতপাঁচ ভেবে দরজাটা খুলেই দিল।
বাইরে দাড়িগোঁফওয়ালা একটা নোক দাঁড়ানো। তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গায়ে ঢলঢলে একটা রংচটা জামা, পরনে লুঙ্গি, পিঠে একটা বস্তা ঝুলছে।
টেমিটা তুলে ধরে লোকটার মুখটা ভাল করে দেখে নিয়ে নয়নতারা ঝাঁঝের গলায় বলল, “কী চাই?”
লোকটা জুলজুল করে চেয়ে থেকে বলল, “এটাই কি পরাণ দাসের বাড়ি?”
নয়নতারা বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু সে এখন বাড়িতে নেই।”
“শুনেছি সে একজন গুণী মানুষ, তাই দেখা করতে আসা।”
নয়নতারা ঠোঁট উলটে “গুণী না হাতি! যার দু’বেলা দু’মুঠো চালের জোগাড় নেই তেমন গুণীর গলায় দড়ি।”।
লোকটা এ কথায় যেন ভারী খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “কথাটা বড্ড ঠিক। তবে কিনা এই পোড়া দেশে গুণের আদরই বা কই? তা সে গেল কোথায়?”
“তা কি আমাকে বলে গেছে? এ-সময়ে সে কাজে বেরোয়।”
লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলে, “এ-সময়ে তার কী কাজ! সন্ধেবেলায় তো তার কাজে বেরোনোর কথা নয়! কাজ তো নিশুত রাতে।”
নয়নতারা সপাটে বলল, “সে সব আমি জানি না, মোট কথা সে বাড়িতে নেই।”
লোকটা গোঁফ দাড়ির ফাঁকে ভারী অমায়িক একটু হেসে বলল, “তা বললে হবে কেন মা, আমি যে টেমির আলোতেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, পান্তাভাত পাতে পড়ে আছে এখনও।”
নয়নতারা নির্বিকার মুখে বলল, “ও তো আমি খাচ্ছিলাম।”
“মাচানের তলা থেকে কার যেন শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজও পাচ্ছি যে। আমার কানটা যে বড় সজাগ। হাঁড়িকুড়ির ফাঁক দিয়ে দু’খানা জুলজুলে চোখও দেখা যাচ্ছে!”
পরাণ আর থাকতে না পেরে হামা দিয়ে বেরিয়ে এল। গা-টা একটু ঝেড়েঝুড়ে লোকটার দিকে চেয়ে বলল, “কী মতলব হে তোমার?”
লোকটা মিষ্টি করেই বলল, “বলি দরজার বাইরে থেকেই বিদেয় করতে চাও নাকি? বাড়িতে অতিথি এলে একটু বসতেটসতেও কি দিতে নেই?”
পরাণ একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “তা ভিতরে এলেই হয়।” নয়নতারা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। লোকটা ঘরে ঢুকে চারদিক চেয়ে একবার দেখে নিয়ে বলল, “সতু ঘোষের বাড়ি থেকে ফুলদানি দুটো সরালে বুঝি!”
পরাণ অবাক হয়ে বলে, “তুমি জানলে কী করে হে?”
“কয়েকদিন আগে আমিই সতু ঘোষের বউয়ের কাছে দশ টাকায় ও দুটো বেচে গেছি কিনা।”
নয়নতারা নথ নাড়া দিয়ে বলল, “গুণী লোকের মুরোদটা দেখলেন তো! অন্যেরা কত সোনাদানা চেঁছেছে নিয়ে আসছে, কত চোরের বউ সোনার চুড়ি বালা বেনারসি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ইনি মদ্দ সারারাত গলদঘর্ম হয়ে এনেছেন দুটো কাঁচের ফুলদানি! ম্যা গো, ঘেন্নায় মরে যাই।”
লোকটা দাঁড়ি গোঁফের ফাঁকে ঝিলিক তুলে হেসে বলল, “একটা মাদুর টাদুর হবে? তা হলে একটু বসি। অনেক দূর থেকে আসা কিনা, মাজাটা টনটন করছে।”
নয়নতারা একটা ঘেঁড়াখোঁড়া মাদুর পেতে দিল। তারপর ঝংকার দিয়ে বলল, “আর কী লাগবে শুনি!
লোকটা মাদুরে বসে একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, “তা লাগে তো অনেক কিছু। প্রথমে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল, তারপর একটু চা-বিস্কুট হলে হয়, রাত্তিরে দুটো ডালভাত। কিন্তু বাড়ির যা অবস্থা দেখছি তাতে ভরসা হচ্ছে না। তা বাপু পরাণ, তোমার সময়টা কি খারাপ যাচ্ছে।”