সত্যগোপাল দুঃখ করে বলল, “মাছের ওপর বারোটা কোটেশন মুখস্থ ছিল রে, সেগুলো যে জলে গেল।”
“তাতে কী, বক্তৃতা তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না। এই তো কাল কালীতলায় নবীন সঙ্ঘের সঙ্গে ভবতারিণী বিদ্যাপীঠের বিন্ধ্যবাসিনী স্মৃতি শিন্ডের ফাঁইনাল ফুটবল ম্যাচেও আপনি সভাপতি। কোটেশনগুলো সেখানেই ঝেড়ে দেবেন।”
“দূর! ফুটবলের সঙ্গে কি মাছ যায়!”
“আহা, লোকে অত খতিয়ে দেখে না। এই তো সেদিন তাঁতিপাড়ায় অষ্টপ্রহর মহানাম সংকীর্তনের উদ্বোধনী ভাষণে আপনি পাটচাষিদের দুঃখ আর চিংড়ির ফলন বাড়ানোর কথা বললেন, কেউ কিছু আপত্তি করেছে কি? লোকে তো হাততালিও দিল। বললুম না, লোকে অত তলিয়ে বোঝে না। আপনার বক্তৃতার ডেস্থ বোঝার এলেমই নেই ওদের।”
বাড়ির বাইরেই একটা হোঁকা এবং একজন রোগাটে চেহারার লোক পায়চারি করছিল। রোগা লোকটার পরনে দামি ধাক্কাপেড়ে ধুতি, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, বাবরি চুল, পুরুষ্টু গোঁফ, পায়ে নাগরা। দেখলে সম্রম হয়। সত্যগোপালকে দেখে এগিয়ে এসে হাতজোড় করে বলল, “আপনিই সত্যগোপাল ঘোষ? বড়ই সৌভাগ্য আমার।”
সত্যগোপাল বলল, “সভা কোথায় বলুন তো!”
“আজ্ঞে, সভা নয়।”
“তবে কি ফাংশন?”
“আজ্ঞে না।”
“তা হলে নিশ্চয়ই ফুটবল ম্যাচ!”
“আজ্ঞে না। ওসব নয়।”
“কেত্তনের আসরেও আমি যাই বটে। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। খোল কত্তালের শব্দে আমার বড় মাথা ধরে যায়। তা আপনাদের কেত্তনটা হবে কোথায়?”
“কেত্তনের শব্দে আমার আবার মাথা ধরে না, মাথা ঘোরে।”
“সেটাও খুব খারাপ জিনিস।”
“খারাপ বলে খারাপ! আমাদের ঠাকুরদালানে তো রোজ সন্ধের পর কেত্তনের আসর বসত। বড় বড় কীর্তনীয়া আসত। আমরা ঠাকুর্দা রাজা তেজেন্দ্রনারায়ণের আবার খুব কেত্তনের বাই ছিল কিনা।
“রাজা! আপনি কি রাজপুত্তুর নাকি মশাই! আগে বলতে হয়! এঃ হেঃ, আপনার এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা তো ঠিক হচ্ছে না! কী বলিস প্যাংলা?”
প্যাংলা বিগলিত হয়ে বলল, ‘সর-ননী খাওয়া শরীর তো, ঘ্যাচাং করে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।”
লোকটা মৃদু হেসে বলল, “আরে না না। রাজত্বই নেই তো রাজা। রাজাগজা নই। ওই পৈতৃক বাড়িটাই যা আছে। ঠাটবাট বজায় রাখাই কঠিন।”
প্যাংলা বলল, ‘কিন্তু আপনার ঠাটবাট তো কিছু কম দেখছি না। আঙুলে আংটি ঝিলিক মারছে, তা ধরুন দু-চার হাজার টাকা তো হবেই! পায়ের জুতোজোড়াও চমকাচ্ছে, তা ধরুন এক দেড়শো টাকা হেসেখেলে দাম হবে না?”
তা হবে বোধহয়। দেওয়ান জ্যাঠা জানেন। কেনাকাটা তো আর আমরা করি না। দেওয়ান জ্যাঠাই করেন।”
সত্যগোপাল বলল, “তা রাজবাড়িটা কি কাছেপিঠে কোথাও?”
“বেশি দূরেও নয়। কেতুগড়ের নাম শুনেছেন কি?”
সত্যগোপাল একটু ভাবিত হয়ে বলল, “তা শুনেছি বোধহয়। নামটা যেন চেনা-চেনা ঠেকছে। কী বলিস রে প্যাংলা?”
“কেতুগড় তো! তা কেতুগড়ের নাম কি আর শুনিনি। কত জায়গারই নাম নিত্যি শুনছি, কেতুগড় আর কী দোষ করল? তা কেত্তনটা হচ্ছে কবে?”
মাথা নেড়ে লোকটা বলল, “কেত্তন হচ্ছে না। আমি বর্তমান রাজা দিগিন্দ্রনারায়ণের ভাইপো নরেন্দ্রনারায়ণ। রাজবাড়ি থেকে সম্প্রতি কিছু জিনিস চুরি গেছে। খবর আছে জিনিসগুলো এই ময়নাগড় এবং আশেপাশেই আছে। আমরা সেগুলো উদ্ধার করতে বেরিয়েছি। বিশেষ করে রুপোয় বাঁধানো একটা বাঁশি।”
সত্যগোপাল অবাক হয়ে বলল, “বাঁশি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। বহু পুরনো জিনিস। শ’দেড়েক বছর আগে কেতুগড় রাজবাড়ির দরবারে মোহন রায় নামে একজন বাঁশুরে ছিলেন। ভবঘুরে আর ক্ষ্যাপাটে গোছের লোক। মাঝে মাঝে কোথায় উধাও হয়ে যেতেন। কেউ বলত লোকটা মস্ত সাধক, কেউ বলত জাদুকর। তাঁকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। চুরি যাওয়া বাঁশিটা তাঁরই। আমরা সেটা উদ্ধার করতে এসেছি। হাজার টাকা পুরস্কার। আপনি তো গণ্যমান্য লোক, সবাই আপনাকে ভারী ভক্তিশ্রদ্ধা করে। আপনি একটু চেষ্টা করলে বাঁশিটা উদ্ধার হয়।”
“বাঁশিটাই খুঁজছেন কেন বলুন তো?”
“আজ্ঞে, পুরনো জিনিস তো, একটা স্মৃতিচিহ্ন। তা ছাড়া লোকে বলে, ও বাঁশি আর কেউ বাজাতে পারে না। যদিও বা কেউ বাজাতে পারে তা হলে সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়বে। আমরা আসলে কথাটা বিশ্বাস করি না। গুজবই হবে। তবু বলাও তো যায় না। আমরা চাই
বেঘোরে একটা লোকের প্রাণ যাক। আপনি একটু চেষ্টা করলে বাঁশিটা উদ্ধার হয়। একটা লোকের প্রাণও বাঁচে।”
২. সন্ধে রাত্তিরে পরাণ চাট্টি
সন্ধে রাত্তিরে পরাণ চাট্টি পান্তা নিয়ে বসেছে। পান্তা খেয়ে সে একটু গড়িয়ে নেবে। তারপর চটের থলিটি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। ওই থলিটিতে নানারকম ছোটখাটো যন্ত্রপাতি আছে।
দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। রোজগারপাতি নেই বললেই হয়। এই গরমটা পড়াতেই কাজ ভণ্ডুল হচ্ছে বড়। যত গরম পড়ে ততই লোকে হাঁসফাঁস করে, রাতে ঘুমোত চায় না, ঘুমোলেও তেমন গভীর ঘুম হয় না। আর গেরস্ত না ঘুমোলে পরাণেরও কাজ হতে চায় না। যতদিন বর্ষা বাদলা না নামছে ততদিন টানাটানি যাবেই। বর্ষা বাদল হলে আবহাওয়া ঠাণ্ডা হবে। বৃষ্টির শব্দ আর ব্যাঙের ডাকে মানুষ টেনে ঘুমোবে, আর তখনই পরাণের বরাত খুলবে।
তার বউ গোমড়ামুখো নয়নতারা পান্তা ভাতের থালাটা পরাণের সুমুখে নামিয়ে দিয়ে একটু আগেই বলছিল, ‘চাল কিন্তু তলানিতে ঠেকেছে। কাল একবেলারও খোরাকি হয় কি না কে জানে। বলে রাখলুম, ব্যবস্থা দেখো।”