মৎস্যজীবীদের সভায় মাছ নিয়ে অনেক কথাই বলার ছিল সত্যগোপালের। যেমন, ভগবান একবার মৎস্য অবতার হয়ে এসে পৃথিবী উদ্ধার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের একটা কোটেশনও ঠিক করা ছিল, মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে, এখন সুখেতে তারা জলক্রীড়া করে। তারপর আরও কোটেশন, মৎস্য মারিব, খাইব সুখে এবং মাছের মায়ের পুত্রশোক, এবং মাছের তেলে মাছভাজা। তা ছাড়া না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে এবং কৈ মাছ ভাজা খেতে শৈল গেছে ভুলে–এ দুটো কোটেশনও জুতসই জায়গায় লাগানোর মতলব ছিল তার। কিন্তু সবে ‘ভাই ও বন্ধুগণ” বলে বক্তৃতা শুরু করতেই কে বা কারা যেন বাঁ ধার থেকে চেঁচিয়ে উঠল। “ওই যে, বাবুরাম আসছে!”
সত্যগোপাল যে বাবুরামকে যমের মতো ডরায় তার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় সে একদিন ইস্কুল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ফেরার পথে কলা খেয়ে কলার খোসাটা বাবুরামের গায়ে ছুঁড়ে মেরেছিল। বাবুরাম তাতে কিছু মনে করেনি, খোসাটা অবহেলার সঙ্গে খেয়ে নিয়ে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইল। কিন্তু বচা বলল, “এ তুই কী করলি সতু? বাবুরাম কে জানিস! সাক্ষাৎ শিবের চেলা। সবাই বাবুরামকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে। এঁটো কলার খোসা ছুঁড়ে মারলি, তোর পাপ হবে না?!!”
সত্যগোপাল উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “তা হলে কী করব?”
“যা, ওকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আয়।”
কাজটা সহজ নয়। বুকের পাটা দরকার। কিন্তু সামনেই অ্যানুয়েল পরীক্ষা, এ সময়ে ভগবান পাপ দিয়ে ফেললে যে, পরীক্ষায় ডাব্বা মারতে হবে সেটা চিন্তা করেই সত্যগোপাল মরিয়া হয়ে সন্তর্পণে গিয়ে কী করে বাবুরামের সামনের দুটো পায়ের খুর ছুঁয়ে মাথায় ঠেকিয়েই দৌড়ে পালিয়ে এল।
বচা বলল, “দূর! তুই তো ওর হাতে প্রণাম করলি। হাতে প্রণাম করলে কি পাপ কাটে?”
“যাঃ, ওটা হাত কেন হবে? গোরুর তো চারটেই পা।”
“তোকে বলেছে! পা বলে মনে হলেও বাবুরামের সামনের পা দুটো মোটেই পা নয়, হাত। পিছনের পা দুটোই আসল পা।”
এ কথায় একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল সত্যগোপাল। কে জানে বাবা, হতেও পারে। বুক বেঁধে সুতরাং সে দ্বিতীয়বার বাবুরামের দিকে এগিয়ে গেল। এবং খুব দুঃসাহসের সঙ্গে পিছনের পা দুটোর খুরে হাত দিল।
কলার খোসা ছোঁড়া এবং প্রথমবার পায়ের ধুলো নেওয়া পর্যন্ত সহ্য করেছে বাবুরাম। কিছু বলেনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার তার পায়ে হাত দেওয়ায় বাবুরাম অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে তেড়ে ফুড়ে উঠে এমন তাড়া লাগাল সত্যগোপালকে যে আর কহতব্য নয়। সত্যগোপাল শেষ অবধি পালঘাটের খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচায়। সত্যগোপালের ধারণা, বাবুরাম আজও ঘটনাটা ভোলেনি। কালেভদ্রে তাকে দেখলে বাবুরাম দূর থেকেও তার দিকে আড়ে আড়ে চায় আর ফোঁস ফোঁস করে।
সুতরাং বাবুরাম আসছে শুনে যদি সত্যগোপাল মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়িমরি দৌড় লাগায় তাতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। এই দৌড়টা অতি ছোঁয়াচে জিনিস। সত্যগোপালকে দৌড়োতে দেখে বুড়ো নিবারণবাবুও মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় লাগালেন। পিছনে প্যাংলাও।
ইস্কুলে লেখাপড়ায় ডাব্বা মারলেও স্কুলের স্পোর্টসে বরাবর সত্য ফাস্ট সেকেন্ড হয়ে প্রাইজ পেয়েছে। দৌড়টা তার ভালই আসে। জেলেপাড়ার রাস্তা ধরে সে দৌড়োচ্ছিলও ভালই। কিন্তু দেখা গেল আশি বছরের নিবারণবাবুও কম যান না। তিনি প্যাংলাকে ছাড়িয়ে সত্যগোপালকে প্রায় ধরে ফেললেন। ছুটতে ছুটতেই বললেন, “হুঁ হুঁ বাবা, বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখেছ, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে।”
অবাক সত্যগোপাল বলে, “তাই দেখছি! রোজ সকালে উঠে দৌড় প্র্যাকটিস করেন নাকি?”
“পাগল হয়েছ? ওসব আমার পোষায় না। তবে আমার একটা কেলে গোরু আছে। সেটা ভয়ানক পাজি। রোজই খোঁটা উপড়ে পালায়। সেটাকে ঘরে আনতে রোজ বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। আর এই করতে গিয়ে আমার হাঁটুর বাত, মাজার ব্যথা, অনিদ্রা সব উধাও হয়েছে। আজকাল খুব খিদে হয়, ঘুমটাও হচ্ছে পাথরের মতো। সব জিনিসের ভাল আর মন্দ দুটোই আছে, বুঝলে ভায়া? এখন তো মনে হয়, শূন্য গোয়ালের চেয়ে দুষ্টু গোরুই ভাল।”
সত্যগোপাল হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “বাবুরাম কি এখনও তেড়ে আসছে?”
নিবারণবাবু অবাক হয়ে বললেন, “বাবুরাম। কোথায় বাবুরাম?”
“এই যে কে বলল, বাবুরাম আসছে!”
“দুর দূর! তুমিও যেমন! বাবুরাম আসবে কি, আজ জামতলায় নবীন পালের বাড়িতে মদনমোহনের কাঁঠালভোগ। রাজ্যের কাঁঠাল এসেছে ভোগে। বাবুরাম বিকেল থেকেই সেখানে থানা গেড়েছে। যা কাঁঠাল সেঁটেছে তার আর নড়ার সাধ্যি নেই।”
“তা হলে আপনি ছুটছেন কেন?”
“আহা, আমি তো তোমার দেখাদেখি ছুটছি। তোমাকে অমন আচমকা ছুটতে দেখে ভাবলাম, সত্যগোপাল যখন ছুটছে তখন নিশ্চয়ই কোনও বিপত্তি ঘটেছে।”
সত্যগোপাল দাঁড়িয়ে খানিক দম নিল। ছিঃ ছিঃ, এখন ভারী লজ্জা করছে তার। পাবলিকের সামনে ওরকম কাপুরুষের মতো পালিয়ে আসাটা তার উচিত হয়নি। তার ভাবমূর্তিটা যে একেবারে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল!
বাড়ি ফেরার সময় প্যাংলা অবশ্য বলল, তার ভাবমূর্তির কোনও ক্ষতি হয়নি। পরিস্থিতির চাপে মাঝে-মাঝে নেতাদের ভাবমূর্তি টলোমলো হয় বটে, কিন্তু দু-চারদিনের মধ্যেই আবার আঁট হয়ে বসে যায়। তার কারণ, পাবলিক কোনও ঘটনাই বেশিদিন মনে রাখতে পারে না।