পান্নালালবাবুকে সান্ত্বনা দিতে এসে মনোরঞ্জন কম্পাউন্ডার বলল, “ও হে পান্নালাল, এ হল ভাগ্যের খেলা। ভাগ্য জিনিসটা কেমন জানো? সোঁদরবনের বাঘ। কোথায় যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে টেরটিও পাবে না। হঠাৎ ঘাড়ে এসে লাফিয়ে পড়ে টুটি কামড়ে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে গিয়ে সাকসেসের চূড়ায় পৌঁছে দিয়ে বসে বসে কলসা নাড়বে। বুঝলে!”
পান্নালালাবাবু বুঝলেন কি না বোঝা গেল না। তবে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন। ছাত্রের কৃতিত্ব দেখে তিনি বিশেষ পুলকিত হয়েছেন বলে মনে হল না।
যাই হোক, সত্যগোপাল এখন একজন ভারী ব্যস্ত মানুষ। এখানে উদ্বোধন, সেখানে বৃক্ষরোপণ, কোথাও মূর্তি উন্মোচন, তারপর রক্তদান শিবির, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান– সত্যগোপালের কি নাওয়া-খাওয়ার সময় আছে। সভা-সমিতির ছাড়া সে থাকতেও পারে না। তার ভারী আইঢাই হয়।
আজ ময়নাগড়ে বামাসুন্দরী কলেজে বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা আলোচনা সভা ছিল। সভাপতির ভাষণ দিতে উঠে সত্যগোপাল বলল, “আমাদের চারদিকে তো বিজ্ঞান ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। চারদিকে যেন বিজ্ঞানের ঢেউ খেলছে। এই যে হাতে হাতঘড়ি চলছে, বিজ্ঞান। ওই যে মাথার ওপর পাখা ঘুরছে, বিজ্ঞান। ওই যে পকেটের ডটপেনটা, বিজ্ঞান। এই যে ধুতি-জামা পরে আছি, বিজ্ঞান, মোটরগাড়ি চলছে, রেলগাড়ি ছুটছে, এরোপ্লেন উড়ছে, সব বিজ্ঞান, সব বিজ্ঞান। এই যে মাইকে কথা বলছি এটা অবধি বিজ্ঞান। কিছুদিন আগে শহরে গিয়ে দেখে এলাম, সেখানে বিজ্ঞানের একেবারে মোচ্ছব লেগে গেছে। সর্বত্র কেবল কম্পাউন্ডার আর কম্পাউন্ডার। অফিসে কম্পাউন্ডার, ব্যাঙ্কে কম্পাউন্ডার, ডাকঘরে কম্পাউন্ডার, হাসপাতালে কম্পাউন্ডার। শোনা যাচ্ছে, এবার থেকে কম্পাউন্ডাররাই সব কিছু করবে! চাষবাস, চিকিৎসা, হিসেবনিকেশ, চিঠিপত্র লেখা, সবই নাকি করবে কম্পাউন্ডার। এমনকী তারা ছবি আঁকবে, কবিতা লিখবে, কলকারখানা চালাবে। মানুষ গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে শুধু।”
শ্রোতাদের মধ্যে মনোরঞ্জন কম্পাউন্ডার ছিল। শ্রোতারা খুব হাসাহাসি করছিল বটে, কিন্তু সে চিন্তিত মুখে পাশে বসা গিরিন খাসনবিশকে ফিসফিস করে বলল, “কম্পাউন্ডারদের ঘাড়ে এত কাজ চাপিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে ভায়া? এই বুড়ো বয়সে আমি কি অত কাজ পেরে উঠব? এ তো খুব চিন্তার কথা হে।”
গিরিন খাসনবিশের ওষুধের দোকান। সে চাপা গলায় বলল, “ভাবছেন কেন? এ তো দেখছি কম্পাউন্ডারদের কপাল খুলে গেল! যাকে বলা যায় কম্পাউন্ডারদের স্বর্ণযুগ! পেটেন্ট ওষুধের দাপটে কম্পাউন্ডারদের চাকরি যাওয়াতেই বোধহয় সরকার বাহাদুর নড়েচড়ে বসেছে। এতদিনে তাদের হিল্লে হল।”
“তা বলে ছবি আঁকা! কবিতা লেখা! ওসব কি পেরে উঠব?”
“চেষ্টা করলে লোকে কি না পারে বলুন!”
সত্যগোপাল হাসি হাসি মুখে বলল, “বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অবদান হল ওই কম্পাউন্ডার।”
পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সচ্চিদানন্দবাবু পাশ থেকে সসম্ভ্রমে চাপা গলায় বললেন, “ওটাকে কেউ কেউ কম্পিউটারও বলে থাকে।”
সত্যগোপাল একটু অবাক হয়ে বলে, “বলে নাকি?”
কলেজের ফিজিক্স ল্যাবরেটারির জন্য দু’লাখ টাকার একটা সরকারি অনুদান কিছুদিন আগে এই সত্যগোপালই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। তা ছাড়া সচ্চিদানন্দবাবুর সেজো মেয়েটার বিয়ের সম্বন্ধও হচ্ছে আবার সত্যগোপালের শালার সঙ্গে। তাই সচ্চিদানন্দবাবু খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “বললেও হয়। কম্পাউন্ডারও যে চলে না তা নয়, তবে কম্পিউটার কথাটারই চল একটু বেশি আর কী।”
প্রবল হাততালির শব্দে অবশ্য সচ্চিদানন্দবাবুর কথা শোনা গেল না।
হাতজোড় করে সত্যগোপাল সমবেত শ্রোতার হাততালি হাসি হাসি মুখ করে গ্রহণ করল। সে যখনই যেখানে বক্তৃতা করে সেখানেই হাততালির একেবারে বন্যা বয়ে যায়। অবশ্য একথাও ঠিক যে, সব হাততালি সবসময়ে জায়গামতো পড়ে না, উলটোপালটা জায়গাতেও পড়ে। যেখানে পড়ার কথা নয়, সেখানেও। এই তো সেদিন গোবিন্দপুরের বৃক্ষরোপণ উৎসবে গিয়ে বক্তৃতায় তাড়াহুড়োয় বৃক্ষকে বিক্ষ বলে ফেলেছিল বলে খুব হাততালি পড়ল। তারপর গয়েশবাবুর শোকসভাটায় হল কী, তিরোধান কথাটা ভুল করে অন্তর্ধান বলে ফেলেছিল সত্যগোপাল। হাততালি আর থামতে চায় না। তা হোক, উলটোপালটা পড়লেও ওই হাততালিই সত্যগোপালকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওই হাততালিই তাকে চাঙ্গা রাখে।
হাততালি তখনও থামেনি, সত্যগোপালের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্যাংলা এসে তার কানে কানে বলল, “ওদিকে যে পালঘাটে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভার সময় পার হয়ে যাচ্ছে দাদা। দেখে এলাম সভাপতির মালা শুকিয়ে গেছে, প্রধান অতিথি বুড়ো নিবারণবাবু টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে কাদা, তাঁর নাক ডাকছে। আরও ভয়ের কথা হল, সভার মাঠেই বাজারের ষাঁড় বাবুরাম রাতে এসে শোয়। সে এসে পড়লে সভা ভেঙে যাবে।”
সত্যগোপাল “তাই তো!” বলে তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়ল। সভায় পৌঁছে দেখা গেল, মহিলারা রান্না চাপাতে বাড়ি ফিরে গেছে, ফাঁকা জায়গায় বাচ্চারা হইহই করে খেলছে, দু-চারজন লোক এধারে ওধারে বসে গুলতানি করছে। কর্মকর্তারা অবশ্য সত্যগোপালকে খুব খাতির করে নিয়ে মঞ্চে তুলে দিল। সমিতির সম্পাদক বলল, “একটু তাড়াতাড়ি করবেন সত্যবাবু। ওই বাবুরাম ষাঁড়টা বড় বজ্জাত। যেমন গোঁ, তেমনি তেজ। তার আসার সময়ও হয়েছে কিনা।”