টাকার গন্ধে রাখালের চোখ আরামে বুজে আসছিল, এমন সময় ছত্রিশ নিয়ে গণ্ডগোলটা তার কানে গেল। সে খুব ঠাহর করে সমস্যাটা শুনে নিয়ে হাঁদুকে বলল, “তোমার ছত্রিশ অবধি যাওয়ার দরকার কী? একটু কমিয়ে, কাটছাঁট করে তেত্রিশে নামিয়ে আনে। দেখবে ল্যাটা চুকে যাবে। তেত্রিশের যা নামবে তাই হাতে থাকবে। বুঝেছ? যা খুশি নামাও, ওঠাও, কোনও অসুবিধে নেই।”
হাঁদু চটে উঠে বলল, “ওই জন্যই তো তোমার কিছু হল না। শুয়ে, বসে আর ঝিমিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলে। যত সব মুখ এসে জোটে আমার কপালে। একটা সোজা অঙ্কের সোজা নিয়ম, তাই পেরে উঠছ না! ছত্রিশের কত নামে আর কত হাতে থাকে এ তো বাচ্চা ছেলেরও জানার কথা।”
এমন সময়ে কাছেপিঠে যেন বাজ পড়ার শব্দ হল। বাজ নয় অবশ্য, একটা বাজখাই গলা বলে উঠল, ছত্রিশের ছয় নামবে, হাতে থাকবে তিন।”
দৈববাণী হল কি না বুঝতে না পেরে হাঁটু ওপর দিকে চেয়ে দেখল। দৈববাণী অবশ্য হাঁদুর জীবনে নতুন কিছু নয়। কোনও বেয়াড়া, মতলববাজ খদ্দের এলে তার কানে কানে ফিসফিস করে দৈববাণী হয়। “দিও না হে একে ধারকর্জ দিও না।” কিন্তু এরকম বজ্রপাতের মতো বিকট দৈববাণী সে আর শোনেনি।
দৈববাণীর উদ্দেশে হাতজোড় করে একটা নমো ঠুকে হাঁটু ছত্রিশের ছয় নামাতে যাচ্ছিল, এমন সময় সেই দৈববাণীর গলাটাই দরজার কাছে থেকে এক পরদা নীচে নেমে বলল, “ভিতরে আসতে পারি?”
হাঁদু দেখল দরজার বাইরে দুটো লোক দাঁড়িয়ে। সামনের লোকটার পোশাকআশাক, গলার চেন, হাতে হিরের আংটি লক্ষের আলোতেও চোখে পড়ার মতো। সাধারণ খদ্দের নয়।
হাঁদু শশব্যস্তে বলল, “আসুন, আসুন। আস্তাজ্ঞে হোকে, বস্তাজ্ঞে হোক।”
রোগাটে, লম্বাটে, ফর্সাটে, গুফো এবং বাবরিবান লোকটাকে দেখে বিশু আর রাখালও নড়েচড়ে বসল।
হাঁদু হাতজোড় করে বলে উঠল, “আজ্ঞা করুন।“
লোকটা চারদিকটা একবার উদাস চোখে দেখে নিয়ে তার রাজকীয় গলায় বলল, “আমি কেতুগড় রাজবাড়ি থেকে আসছি। আমার নাম নরেন্দ্রনারায়ণ। আমি রাজা দিগিন্দ্রনারায়ণের ভ্রাতুস্পুত্র।”
হাঁদু বিগলিত হয়ে বলল, “কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য! এ যে ভাঙা ঘরে চাঁদের উদয়! এ যে ইঁদুরের গর্তে বেড়াল! এ যে এঁদো পুকুরে গাদাবোট! আরও কী যেন… ওহে বিশু, বলো না!”
বিশু কিছু বলার আগেই রাখাল বিশ্বাস বিগলিত হয়ে বলে ফেলল, “এ যেন পায়েসের বাটিতে পরমান্ন! এ যেন গদাহস্তে ভীমের প্রবেশ…”
বিশু তাড়াতাড়ি উঠে পায়ের ধুলো নিয়ে একগাল হেসে বলল, “তাই বলুন। দেখেই কেমন চেনা-চেনা লাগছিল।”
নরেন্দ্রনারায়ণ বরাভয়ের মুদ্রায় সবাইকে শান্ত করে তেমনি গম্ভীর গলায় বলল, “বিশেষ প্রয়োজনেই আমার ময়নাগড়ে আসা। রাজবাড়ি থেকে কিছু জিনিস চুরি গেছে। খবর পাওয়া গেছে দাড়ি গোঁফওয়ালা একজন মধ্যবয়সী লোক জিনিসগুলো এই গাঁয়ে এবং আশেপাশে বিক্রি করে গেছে। আমরা সেইসব জিনিসের সন্ধানেই এসেছি। আপনারা যদি কেউ কিছু কিনে থাকেন তা হলে আমরা সেগুলো ডবল দামে কিনে নেব। তবে সবচেয়ে গুরুতর জিনিসটি হচ্ছে একটা রুপোয় বাঁধানো বাঁশি। অন্য জিনিস পাওয়া না গেলেও বাঁশিটা আমাদের খুবই দরকার। ওটার জন্য হাজার টাকা পুরস্কার।
হাঁদুর বুক ধকধক করছে। দু-দুটো মোহর মাত্র ত্রিশ টাকায় কিনেছে সে। ডবল দাম পেলেও তো মোটে ষাট টাকা। মোহরের দাম যে অনেক বেশি। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বিগলিত মুখে বলল, “এসেছিল বটে একটা পাগলা মতো লোক। আমি চোরাই জিনিস দেখেই বুঝতে পারি কিনা। তাই তাকে বেশি পাত্তা দিইনি। চোর চোট্টাদের সঙ্গে কারবার করে কি মরব রাজামশাই?”
বিশু পাল দুঃখের গলায় বলল, “আহা, ডবল দামের কথা আগে জানলে কিছু জিনিস কিনে রাখতাম।”
রাখাল বিশ্বাসও বলল, ওঃ বড় ভুল হয়ে গেছে। লোকটা আমার বাড়িতেও এসেছিল বটে। তা রাজামশাই বাঁশিটা কি রুপোয় বাঁধানোনা হলেও চলবে? আমার সেজো ছেলে গুলু কয়েকদিন হল একটা বাঁশি হাতে ঘোরাঘুরি করছে দেখছি।”
নরেন্দ্রনারায়ণ দৃঢ়তার সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “না, আমাদেরটা রুপোয় বাঁধানো এবং অনেক দিনের পুরনো। ও বাঁশি যার-তার হাতে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক।”
ক্লাস ফাঁইভ থেকে সিক্সে উঠতে সত্যগোপালের লেগেছিল দু’বছর। সিক্স থেকে সেভেনে উঠতে পাক্কা তিন বছর। সেভেন থেকে এইটে উঠতে আরও তিন। প্রতি ক্লাসে উঠেই মনে হত, পরের ক্লাসটা কত উঁচুতে রে বাপ! তবু সে হাল ছাড়েনি। বিস্তর মেহনতে হাঁচোড়পাঁচোড় করে সে একদিন ক্লাস টেনেরও চৌকাঠ ধরে ফেলল। হেডস্যার পান্নালালবাবু পর্যন্ত অবাক হয়ে বলে ফেললেন, “সুয্যি কি পশ্চিমে উঠল নাকি রে সতু, তুইও ক্লাস টেন-এ উঠে পড়লি! বাঃ বাঃ, বড় খুশি হলুম। আর বছরদশেক আমার চাকরি আছে, তার মধ্যেই মাধ্যমিকের বেড়াটা ডিঙিয়ে যা তো বাবা!”
তা হেডস্যারের স্বপ্ন সার্থক করেছিল সত্যগোপাল। দশ বছর নয়, সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে মাত্র চার বছরের চেষ্টায় মাধ্যমিকও পাশ করে ফেলল।
লোককে অবাক করে দেওয়ায় সত্যগোপালের জুড়ি নেই। মাধ্যমিক পাশ করে সে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে সমাজসেবায় নেমে পড়ল। সবাই জানে যে, সমাজসেবা মানে ভেরেণ্ডা ভাজা। সুতরাং সবাই ধরে নিয়েছিল সত্যগোপালের কিছু হবে না। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সবাইকে ফের অবাকই করে দিয়ে সে গোটা তল্লাটের একজন কেষ্টবিষ্ট হয়ে উঠল। শুধু তাই নয়, এলাকার যত স্কুল কলেজ আছে সে সবকটারই গভর্নিং বডির মেম্বার কিংবা প্রেসিডেন্ট, সব কটা ক্লাবের সে চেয়ারম্যান কিংবা সেক্রেটারি, পঞ্চায়েতের চাঁই, গরিব গুর্বোর নেতা। তল্লাটে যত সভা সমিতি হয় সব জায়গায় তার ডাক পড়ে। হয় সভাপতি, নয় প্রধান অতিথি, কিংবা বিশেষ অতিথি। যে স্কুলে সে পড়ত সেই স্কুলের চেয়ারম্যান হওয়ার পর পান্নাবাবু তো হাঁ। সে এমন হাঁ যে কিছুতেই বন্ধ হয় না। শেষে প্রভঞ্জন ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশনের ছুঁচ উঁচিয়ে ধরার পর সেই হাঁ বন্ধ হল।