নরেন্দ্রনারায়ণ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমাকে রাজামশাই বলে লজ্জা দেবেন না। রাজত্ব থাকলে অবশ্য আজ আমার রাজা হওয়ারই কথা, কিন্তু তা যখন নেই তখন আমি আর রাজাগজা নই, সাধারণ মানুষ।”
লোকটা যাই বলুক এর গা থেকে কালীপদ রাজা-রাজা গন্ধ পাচ্ছিল। ঘরে রাজাগজা আসাতেই কি না কে জানে তার দাঁতের ব্যথাটাও উবে গেছে, সে গদগদ হয়ে বলল, “আহা গায়ে রাজরক্তটা তো আছে। রাজত্ব না থাকলেও কি রাজার মহিমা কমে যায় নাকি? মরা হাতি লাখ টাকা।”
নরেন্দ্রনারায়ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শরীরে রাজার রক্তটাই যা আছে। যাকগে, জাপানি পুতুলটা আপনি বরং রেখেই দিন। ওটা না হলেও আমাদের চলবে। কিন্তু বাঁশিটা আমাদের উদ্ধার করতেই হবে। আপনি কি এব্যাপারে একটু সাহায্য করতে পারেন?”
কালীপদ হাত কচলে বলল, “আজ্ঞে, আপনি যখন আদেশ করলেন তখন অবশ্যই খোঁজ করে দেখব। ও তো কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।”
“আমরা বাঁশির জন্য পুরস্কার দিতেও রাজি আছি আর ডবল দাম তো দেবই।”
কালীপদর চোখ চকচক করে উঠল, বলল, “যে আজ্ঞে।”
.
ময়নাগড়ের সবচেয়ে বড়লোক হল হাঁদু মল্লিক। তার মস্ত সুদের কারবার আর তেলের ব্যবসা। লাখো লাখো টাকা। তবে কিনা হাঁদু মল্লিককে দেখে সেটা বুঝবার উপায় নেই। সে হেঁটো ধুতি পরে, গায়ে মোটা কাপড়ের একখানা বিবর্ণ জামা। পায়ে শস্তা রবারের চটি, বেঁটেখাটো হাঁদু মল্লিক রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বড়মানুষ বলে চেনা দায়।
রোজকার মতোই হাঁদু সন্ধেবেলায় তার গদিতে বসে সারাদিনের হিসেব নিকেশ জাবদা খাতায় টুকে রাখছিল। এ সময়টায় তার বাহ্যজ্ঞান থাকে না। তবে আজ সে কিছু আনমনা। হয়েছে কি, দিনদুই আগে দুপুরের দিকে দাড়িগোঁফওয়ালা একটা লুঙ্গি পরা লোক ঝোলাকাঁধে এসে হাজির। বলল, কোন রাজবাড়ি থেকে নিলামে কিছু জিনিস কিনে এনেছে। রাজবাড়ির জিনিস শুনে হাঁদুর একটু কৌতূহল হল। থলি থেকে বিস্তর অকাজের জিনিস বের করে দেখাল লোকটা। তার মধ্যে গোটা কুড়ি পঁচিশ পুরনো রুপোর টাকাও ছিল। রুপো দামি জিনিস বলে হাঁদু দরদাম করে গোটা দুই কিনে ফেলেছিল ত্রিশ টাকায়। জালি জিনিস হতে পারে ভেবে বেশি কিনতে সাহস হয়নি। কিন্তু গতকাল বিধু স্যাঁকরা এসে টাকাদুটো দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, “করেছেন কী হাঁদুবাবু, এ তো রুপোর টাকা নয়! রুপোর মোড়কে এ যে খাঁটি মোহর! ওজনটা দেখছেন না! রুপোর কি এত ওজন হয়?” বলে বিধু একপাশ থেকে একটু ছিলকে কেটে দেখাল, ভিতরে সোনা চকচক করছে। সেই থেকে মনটা বড় হায়-হায় করছে হাঁদুর। পঁচিশটা টাকা যদি সাহস করে কিনে ফেলত তা হলে কী ভালটাই না হত। এখন তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। এত দুঃখ হচ্ছে যে, হাঁটু ভাল করে খেতে বা ঘুমোতে পারছে না, পেটে বায়ু হয়ে যাচ্ছে, দুঃস্বপ্ন দেখছে। লোকটাকে খুঁজে আনতে সে তার পাইক পাঠিয়েছিল। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে।
গতকাল থেকে তাই মনটা বড় উচাটন। আজ হিসেব করতে বসেও মাথাটা গণ্ডগোল করছে। আজ হয়েছে কি, দু’ হাজার সাতশো নয়ের নয়, আট হাজার পাঁচশো সাতাশির সাত, দশ হাজার নশো আঠাশের আট, পাঁচশো ছাব্বিশের ছয়, সাত হাজার তিনশো বত্রিশের দুই আর দশ হাজার দুশো চুয়াল্লিশের চার, যোগ করে হবে ছত্রিশ। ছত্রিশের ছয় নামবে, হাতে থাকবে তিন। ঠিক এই খানটাতেই তার চল্লিশ বছরের হিসেব করা পাকা মাথায় কেমন যেন হরিবোল হয়ে গেল। কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না ছত্রিশের কত নামবে আর কত হাতে থাকবে। ছয় নেমে হাতে থাকবে তিন, নাকি তিন নেমে হাতে থাকবে ছয়! কোনটা নামে, কোনটা হাতে থাকে তা নিয়ে এমন গণ্ডগোলে সে কখনও পড়েনি। অগত্যা সে বিশু পালকে লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল, “ওহে বিশু, ছত্রিশের কত নামবে আর কত হাতে থাকবে বলে তো!”
বিশু সেই বিকেল থেকে দশটা টাকা হাওলাত চাইতে এসে বসে আছে। হাঁদু মল্লিক রাজি হচ্ছে না। বলেছে, আজ তিন মাস সাড়ে তিনশো টাকা ধার নিয়ে বসে আছ, একটি পয়সা ছোঁয়াওনি। বাহান্ন টাকা সুদ সমেত চারশ দু টাকা আগে শোধ দাও, তারপর নতুন ধারের কথা।
বিশু তবু আশায় আশায় বসে আছে।
ধার চাইতে সে আর যাবেই বা কোথায়। সব জায়গাতেই তার দেনা। ময়নাগড়ের সবাই তার পাওনাদার।
মেজাজটা আজ তার বড়ই খিচড়ে আছে। বিকেলেই দেখে এসেছে, সন্ধ্যা বাজারে মাছওয়ালা সনাতন কাদা চিংড়ির ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে। কাদা চিংড়ি সে বড্ড ভালবাসে। চচ্চড়ি বেঁধে খেতে যেন অমৃত। দশটা টাকা হাওলাত পেলে হয়ে যেত। এতক্ষণ আর সে মাছ পড়ে নেই। হাঁদুর প্রশ্ন শুনে তাই সে খিঁচিয়ে উঠে বলল, “ছত্রিশের কত নামে আর কত হাতে থাকে তার আমি কী জানি! দশটা টাকা যখন ধার চেয়েছিলুম তখন খেয়াল ছিল না যে, এই শর্মাকেও একসময়ে দরকার হবে! দশটা টাকা ফেললেও না হয় চেষ্টা করে দেখতুম। তা যখন দাওনি তখন নিজের হিসেব তুমি নিজেই বোঝো।”
একধারে রাখাল মোক চুপচাপ বসে ছিল। সে হল ময়নাগড়ের সবচেয়ে বোকা তোক। রোজ সন্ধেবেলায় সে হাঁদুর গদিতে টাকার গন্ধ শুকতে আসে। টাকাপয়সার গন্ধ মাখানো বাতাসে শ্বাস নিলে তার ভারী আরাম বোধ হয়। হাঁটু মল্লিকের গদিতে সাতখানা সিন্দুকে টাকাপয়সা আর সোনাদানা গচ্ছিত। বাতাসে মম’ করছে টাকার গন্ধ। সকলে গন্ধটা পায় না বটে, কিন্তু রাখাল মোক পায়। আর সেই গন্ধে তার একটু নেশার মতোও হয়। ঘরে বাইরে সবাই রাখালকে বোকা বলেই জানে, রাখালও লোকের মুখে শুনে শুনে জেনে গেছে যে, সে খুব বোকা। নিজেকে বোকা বলে জানার পর থেকে সে খুব হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। লোকের সঙ্গে কথা কইবার আগেই সে বলে নেয়, “ভাই, আমি বড্ড বোকা, আমাকে একটু ভাল করে বুঝিয়ে বলতে হবে।” বাজারে গিয়ে দোকানিদের সে বলে “আমি বড্ড বোকা তো, তোমরা কিন্তু আমাকে আবার ঠকিয়ে দিও না,” এই তো কয়েকদিন আগে তার বাড়িতে মাঝরাতে চোর ঢুকেছিল। রাখাল ঘুম ভেঙে চোরকে দেখে বলে উঠল, “আহা, করো কী, কয়রা কী, আমি যে বড্ড বোকা মানুষ। আমার বাড়িতে কি চুরি করতে আছে?” চোরটা খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “কে বলল আপনি বোকা? আপনাকে তো বেশ সেয়ানা লোক বলেই মনে হচ্ছে। চোরকে ভড়কে দিতে চান বুঝি?” রাখাল বেশ বুক ফুলিয়ে বলল, “মোটেই সেয়ানা নই হে, ময়নাগড় ছুঁড়লেও তুমি আমার মতো বোকা লোক পাবে না,” চোরটা একটা ফুৎকারে তার দাবি নস্যাৎ করে বলল, “ওই আনন্দেই থাকুন। পদ্মলোচন আঢ্যকে চেনেন? যে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বটপাতা দিয়ে সাজা পান খেয়ে তারিফ করেছিল? আর হরেন পাড়ই কি কম যায় নাকি? পাশের নন্দরামের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, হরেন পাড়ই গিয়ে সর্দারের হাতে পায়ে ধরে বলে কি, আমার বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো না দিলেই যে নয়। নন্দরামের বাড়িতে ডাকাতি হল আর আমার বাড়িতে যদি না হয় তা হলে কি শ্বশুরবাড়িতে আমার প্রেস্টিজ থাকবে? তা আপনি কি তাদের চেয়ে বেশি বোকা? বোকা হলেও আপনি মোটেই এক নম্বর নন, তিন চার বা পাঁচ নম্বর।” রাখাল এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক ওই সময়ে তার বউ উঠে ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়া করায় চোরটা পালিয়ে যায়। উপরন্তু মাঝরাতে চোরের সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে বউয়ের ঘুম ভাঙানোয় বউ রেগে গিয়ে রাখালকে উত্তম কুস্তম বকাঝকা করে। আজকাল তাই নিজের বোকামি সম্পর্কে রাখালের একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। হয়তো সে নিরেট বোকা নয়, তার বোকামিতে হয়তো ফুটোফাটা আছে। চোরটা কত বাড়িতে ঘোরে, কত অভিজ্ঞতা।