ময়নাগড়ের অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার প্রভঞ্জন প্রামাণিক ইঞ্জেকশন ছাড়া কথাই কয় না। যে রুগিই আসুক আর তার যে রোগই হয়ে থাকুক না কেন প্রভঞ্জন আগে তাকে একটা ইঞ্জেকশন ঠুকে দেবেই। রুগিদের উদ্দেশে তার একটাই কথা, ইঞ্জেকশন নাও, সব সেরে যাবে। দেখা যায়, প্রভঞ্জন যেমন ইঞ্জেকশন দিতে ভালবাসে তেমনি অনেক লোক আছে যারা ইঞ্জেকশন নিতেও খুব পছন্দ করে। বুড়ো উকিল তারাপদ সেন তো প্রায়ই সন্ধেবেলা এসে প্রভঞ্জনের ডাক্তারখানায় বসে, আর বলে, দাও তো ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন ঠুকে। ওটি না নিলে আজকাল বড় আইঢাই হয়, কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মনে হয় আজ যেন কী একটা হয়নি। বিশ্বম্ভর সাঁতরা কোনও শুভ কাজে যাওয়ার আগে প্রভঞ্জনের কাছে একটা ইঞ্জেকশন না নিয়ে যায় না। জরুরি মোকদ্দমা বা শ্বশুরবাড়িতে জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্নে যাওয়ার আগে ইঞ্জেকশন একেবারে বাঁধা।
এই তো সেদিন হাটপুকুরের গজানন বিশ্বাসের মেজো মেয়ে শেফালিকে ভূতে ধরেছিল। শোনা সুরে কথা কয়, এলোচুলে ঘুরে বেড়ায়, দাঁতকপাটি লাগে। ওম বদ্যি কিছু করতে পারল না। তখন ডাকা হল প্রভঞ্জনকে। প্রভঞ্জন গিয়েই ইঞ্জেকশন বের করে ওষুধ ভরে উঁচ উঁচিয়ে যেই শেফালির দিকে এগিয়েছে অমনি ভূতটা শেফালিকে ছেড়ে বেরিয়ে এসে হাতজোড় করে বলল, “যাচ্ছি ডাক্তারবাবু, যাচ্ছি। আপনার জ্বালায় কি কোথাও তিষ্ঠোবার উপায় আছে?”
কালীপদকে তিনশো বাহান্ন নম্বর ইঞ্জেকশনটা দিয়ে ঘটনাটা প্রভঞ্জন নিজেই বলেছিল। বলল, “ইঞ্জেকশনে সারে না এমন রোগ দেখিনি বাপু। তোর ব্যথাটা যখন সারছে না তখন ধরে নিতে হবে ওটা তোর আসল ব্যথা নয়, ব্যথার বাতিক। বাতিকও আমি সারাতে পারি বটে, কিন্তু ভয় কী জানিস? ভয় হল, উটের যেমন কুঁজ, গোরুর যেমন গলকম্বল, হাতির যেমন শুড়, তোরও তেমনি ওই বাতিক। বাতিক সারালে তুই কি বাঁচবি?”
সুতরাং ব্যথা-বেদনা নিয়েই কালীপদ বেঁচে আছে। গতকাল তার হাঁটুতে ব্যথা ছিল। আজ হাঁটুর ব্যথা নেই, কিন্তু সকাল থেকে দাঁতের কনকনানি শুরু হয়েছে। সন্ধেবেলা সে এই গ্রীষ্মকালে কম্ফর্টারে গাল মাথা জড়িয়ে বসে আছে আর আহা উঁহু করছে।
এমন সময় দুটো লোক এসে হাজির হল। এলেবেলে লোক নয়, রীতিমতো সম্রান্ত চেহারার একজন মাঝবয়সী মানুষ, তার পরনে রেশমি পাঞ্জাবি, ধাক্কাপেড়ে ধুতি। মস্ত গোঁফ এবং বাবরি চুল। চেহারাটা রোগাটে হলেও বেশ শক্তসমর্থ। দেখে মনে হয় রাজা জমিদারের পরিবারের লোক। সঙ্গে একজন কুস্তিগিরের মতো লোক, যেমন লম্বা তেমন চওড়া।
প্রথমজনই কথা শুরু করল। বেশ গমগমে গলায় বলল, “আমরা একটা জিনিসের সন্ধানে অনেক দূর থেকে এসেছি। একটু সাহায্য করতে পারেন?”
এরকম বড় মাপের একজন মানুষ বাড়িতে আসায় ভারী তটস্থ হয়ে পড়ল কালীপদ। হাতজোড় করে “আসুন, আসুন, কী সৌভাগ্য।” বলে তাদের বৈঠকখানায় বসাল। তারপর হাত কচলে বলল, “বলুন কী করতে পারি।”
“আপনি কেতুগড় রাজবাড়ির নাম শুনেছেন?”
“খুব শুনেছি।”
“আমি ওই পরিবারেরই একজন বংশধর। আমার নাম নরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।”।
“কী সৌভাগ্য! আপনিই কি রাজাবাহাদুর?”
লোকটার দাঁতগুলো বেশ বড় বড়। সেই দাঁত দেখিয়ে একটু হেসে বলল, “না, না, রাজাগজা নই। রাজতন্ত্রই নেই তো রাজা। আমাদের অবস্থাও আগের মতো নেই। কিছুদিন আগে কেতুগড়ের রাজবাড়ি থেকে কিছু জিনিস চুরি যায়। ছিচকে চোরেরই কাজ। দামি জিনিসপত্র কিছুই তেমন খোয়া যায়নি। তবু তার মধ্যে দুটো একটা জিনিস পুরনো স্মারক হিসেবে আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান। আমরা জিনিসগুলো উদ্ধার করতে চাই।”
কালীপদ ভারী ব্যস্ত হয়ে বলল, “বটেই তো! তা হলে পুলিশের কাছে–”
লোকটা হাত তুলে তাকে থামাল। হাতে হিরের আংটি ঝিলিক দিয়ে উঠল। লোকটা বলল, “পুলিশকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের তো আঠারো মাসে বছর। চোর ধরতে ধরতে জিনিসগুলো বেহাত হয়ে যাবে। তাই আমরা নিজেরাও একটু চেষ্টা করছি। যে লোকটা চুরি করেছিল সে বুড়োমতো, গোঁফদাড়ি আছে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আমরা খবর পেয়েছি যে এই ময়নাগড়েই কিছু জিনিস বিক্রি করে গেছে।”
লোকটার বর্ণনা শুনে কালীপদর মুখ শুকিয়ে গেল। কেননা কয়েকদিন আগে যখন তার কোমরে ব্যথা হয়েছিল তখন ওই লোকটা তার কাছে এসেছিল বটে, ঝোলার মধ্যে অনেক পুরনো আমলের জিনিস ছিল। তা থেকে একটা ভারী সুন্দর জাপানি পুতুল মেয়ের জন্য কিনেছিল বটে কালীপদ। লোকটা পঞ্চাশ টাকা দাম হেঁকেছিল, শেষে কুড়ি টাকায় দিয়ে দেয়।
সে যখন এসব কথা ভাবছে তখন নরেন্দ্রনারায়ণ তার বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল। একটু হেসে বলল, “জিনিসগুলো আমরা সবই ডবল দামে কিনে নেব। কিন্তু যে জিনিসটা আমাদের কাছে সবচেয়ে জরুরি তা হল একটা বাঁশি। বহু
পুরনো রুপোয় বাঁধানো বাঁশি।”
কালীপদ মাথা নেড়ে বলল, “বাঁশির কথা জানি না। তবে আমি একটা জাপানি পুতুল তার কাছ থেকে কিনেছিলাম বটে।”
“বাঁশিটা কে কিনেছে জানেন?”
“না।”
“এই ময়নাগড়েরই কেউ কিনেছে বলে আমাদের চর খবর দিয়েছে।”
“আমি বাঁশি কিনিনি রাজামশাই। চুরির জিনিস জানলে পুতুলটাও কিনতাম না, লোকটা বলেছিল কোনও রাজবাড়ি থেকে নিলামে কিনেছে।”